ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য। আদিবাসী হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল মধুপুর বন।
মধুপুর গড়ে ৩ জানুয়ারি (২০০৪) বনপ্রহরী ও পুলিশের গুলিতে গারো যুবক পীরেন স্নাল (২৮) নিহত হবার পর সেখানকার আদিবাসীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন । ৪ ও ৫ জানুয়ারি হাজার হাজার আদিবাসী নরনারীর ক্ষোভ, বেদনা, মিছিল ও সমাবেশ দেখে প্রশাসন কিছু সময়ের জন্য হলেও অবনত। বন বিভাগ, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী, পুলিশ প্রশাসন এদেরকে আদিবাসীরা তো বটেই দেশবাসীও। ধিক্কার জানাচ্ছেন।টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া এক স্মারকলিপিতে আদিবাসীরা বনমন্ত্রী, ডিসি, এসপি এবং ডিএফওকে দায়িত্ব থেকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। তাদের অন্যান্য দাবির মধ্যে হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত, “ইকোপার্কবাতিল, আদিবাসীদের ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দান, এবং নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দানের দাবি অন্যতম। ৫ জানুয়ারি টেলকিতে আদিবাসী সমাবেশে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন ইতিমধ্যে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে ।


মধুপুরে সাম্প্রতিক এ হত্যাকাণ্ড আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। আমরা বাইরে  থেকে আঁচ করছিলাম জঙ্গলের মধ্যে গারো আদিবাসীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ  করছেন গত বছর খানেক ধরে । তাদের ক্ষোভের প্রত্যক্ষ কারণ সেখানে পাকা দেয়াল এবং পর্যটনের জন্য স্থাপনা নির্মাণ। গত সরকারের সময় নেয়া মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার। প্রকল্পের আওতায় সাড়ে তিন হাজার বনভূমির চারদিকে ষাট হাজার ফুটের মতো পাকা। দেয়াল তোলার পরিকল্পনা করেছে সরকার যা বাস্তবায়ন করছে বন বিভাগ । দেয়াল তোলার কাজ শুরু হয়েছে ২০০১ সালেই। তবে  বনের মধ্যে এবং আদিবাসীদের বিভিন্ন গ্রাম ঘেঁষে দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো । দেয়ালের সাথে আবার তৈরি হচ্ছে কিছু পাকা ঘরবাড়ি । এ সব পাকা বাড়ি হচ্ছে পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য। এও শোনা  যাচ্ছে দেয়ালের মধ্যে হবে ছোট ছোট লেক, ব্যারাক এবং পর্যটকদের  আকর্ষণের জন্য আরো কিছু ব্যবস্থা।মধুপুরের আদিবাসীরা এই পাকা দেয়াল ও অন্যান্য স্থাপনার ব্যাপারে ঘোরতর  আপত্তি জানাচ্ছেন । তারা বলছেন দেয়াল দিয়ে তাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করা হচ্ছে এবং এতে তাদের আবাদি জমিও হাতছাড়া হবে । আর পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য যে স্থাপনা ও ব্যবস্থা হচ্ছে তাতে তাদের সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হবে। আদিবাসী যেসব নারীরা এখনো বনে জঙ্গলে চলাচল করেন লাকড়ি এবং বুনো ফলমূলের জন্য তারাও আর নিরাপদে চলতে ফিরতে পারবেন না । তাদের এ আশংকার সঙ্গত কারণও আছে। গত কয়েক বছরে মধুপুর গড়ে সাত আটজন গারো নিহত হয়েছেন এবং অনেক নারী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। এসব হত্যা ও অন্যায়ের সুবিচার তারা পাননি।
এসব কারণে তারা তাদের একেবারে গ্রাম ঘেঁষে কোনো দেয়াল বা স্থাপনা  দেখতে চান না। ঘটনা ঘটেছে জঙ্গলের একেবারে ভেতরে, জালাবাধা নামক একটা জায়গায়। এখানে পাকা প্রাচীর এবং পাকা ঘর নির্মাণের কাজ হচ্ছে । আদিবাসীরা বলছেন এ পাকা ঘর আসলে নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য তৈরি হচ্ছে । ঘটনার দিন এলাকাবাসীর কথামতো বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার  গারো মিছিল করে আসছিল জালাবাধার ঐ নির্মাণাধীন প্রাচীর ও ঘরবাড়ির  কাজ বন্ধ করার অনুরোধ নিয়ে । জালাবাধার ঐ জায়গাটিতে বনপ্রহরী ও  পুলিশ আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে ছিলেন। তাদের সাথে মধুপুর থানার ওসিও ছিলেন । নির্মাণস্থলে পৌছাবার আগেই নিরাপত্তা কর্মীরা মিছিলের গতিরোধ করে । আদিবাসীদের অভিযোগ মিছিল এগুবার চেষ্টা করলে বন  প্রহরীরা ও পুলিশ গুলি চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস, ছড়াগুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। ঘটনাস্থলেই পীরেন স্নাল মারা। যান। তার লাশ পুলিশ নিয়ে যায়।  বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মারাত্মকভাবে আহত উৎপল নকরেক (১৮) ঢাকায় অস্ত্রোপচারের পর প্রাণে বেঁচে গেছেন। মধুপুর থানার ওসি বলছেন পুলিশ গুলি চালায়নি। কিছু রাবার বুলেট মেরেছে মাত্র। তার। কথামত বন প্রহরীরাই গুলি চালায়। এর অর্থ নিরাপত্তা কর্মীরা সামনাসামনি গুলি। করেছে ।।
আমরা হাজার পাঁচেক আদিবাসী মিছিল করছিলাম। আমরা সবাই খালি হাতে বনের মধ্যে পাকা দেয়াল নির্মাণ এবং স্থাপনা তৈরির কাজ বন্ধ করার অনুরোধ নিয়ে যাচ্ছিলাম জালাবাধার একটি স্পটের দিকে, যেখানে নির্মাণ কাজ চলছে। স্পটে পৌঁছবার আগেই আমাদের পথরোধ করে বন প্রহরীরা  এবং পুলিশ । আমরা এগুতে থাকলে বন প্রহরী ও পুলিশ আমাদের উপর খুব কাছে থেকে গুলি চালায় ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে,” বললেন মিছিলে  অংশগ্রহণকারী গারো যুবক জর্জ নকরেক।আদিবাসীদের দাবি তাদের মিছিল ছিল শান্তিপূর্ণ এবং তারা ছিলেন খালি হাতে। তাদের উপর সশস্ত্র আক্রমণের কোনো দরকারই ছিল না । যে রাস্তার উপর এ সংঘর্ষ ঘটেছে সেখানে ঘটনার পরের দিন ও রক্তের দাগ। রাস্তার এক পাশে পাকা দেয়াল, কোথাও কোথাও ভাঙ্গা। দেয়ালের ভেতরের  অংশে ঝোপঝাড় । ঐতিহ্যবাহী শালবনের সেই বিশাল গাছ আর নেই । রাস্তার  আরেক পাশে বিদেশী প্রজাতি দিয়ে তৈরি করাবনফাকা ফাঁকা করে লাগানো কৃত্রিম বনের মাঝে আনারস ও পেঁপে ক্ষেত। একটু এগুলেই রাস্তার এক পাশে নির্মিয়মান পাকা দেয়াল এবং স্থাপনা ।
 এখন প্রশ্ন বনপ্রহরী এবং পুলিশ কেন এতো বেপরোয়া হলো কেন এমন  হত্যাকাণ্ড ঘটল । এর উত্তর খুঁজে পেতে হলে মধুপুর গড়ের পুরো চিত্রটা আমাদের। একটু দেখা দরকার। মধুপুর বনের টাঙ্গাইল অংশ ৪৬,০০০ একর জুড়ে এবং ময়মনসিংহ অংশ ১৭,০০০ একরের মতো। টাঙ্গাইলের ডিএফও আবু হানিফ পাটোয়ারীর দেয়া  পরিসংখ্যান অনুসারে টাঙ্গাইল অংশের ৪৬,০০০ একরের মধ্যে রাবার বাগান হয়েছে ৭,৮০০ একরে, বিমানবাহিনী ফায়ারিং রেঞ্জ করার জন্য নিয়েছে ১,০০০ একর, জবর দখল হয়েছে ২৫,০০০ একর এবং বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আছে মাত্র। ৯,০০০ একর ।
মধুপুরে জবরদখল হয়ে যাওয়া বনভূমি আজ কলা ও আনারস বাগান । মধুপুরে। আনারস চাষ দীর্ঘদিনের। গারোরাই প্রথম আনারস চাষ শুরু করেন। পরবর্তীতে। তাদের তৈরি করা আনারস বাগানের একটি বিরাট অংশ চলে যায়  বাঙালিদের হাতে । মধুপুরে কলাচাষের সম্প্রসারণ ঘটেছে দ্রুত। বর্তমানে আনারস ও কলা চাষ এবং তার ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালী বাঙালিরাই। আনারস, কলা, বিদেশী প্রজাতির আগ্রাসন এসবে মধুপুর যখন এক নষ্ট বনভূমি তখন আদিবাসীরা ক্রমাগতভাবে অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন তাদের গ্রামগুলোর  মধ্যে মধুপুরের আদিবাসী মানুষের জীবন-যাপন এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতি এক সময়। ছিল পুরোপুরি বন নির্ভর । কিন্তু মধুপুরের শালবন আজ এক নষ্ট বনভূমি। সেখানে আদিবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত । এরপর যখন তারা দেখছেন তাদের গ্রামের আশপাশ। দিয়ে উঠছে পাকা প্রাচীর এবং দালান-কোঠা তখন আর তাদের নড়াচড়ার জায়গা। থাকছে না ।
আদিবাসীদের ক্ষোভ-প্রতিবাদ-বিরোধ প্রশমনের জন্য সরকার চেষ্টা করেছে। গত বছর জুলাই মাসের চার তারিখে স্বয়ং বনমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ বসেছিলেন। গারো নেতৃবৃন্দের সাথে (দোখলা রেস্ট হাউজে)। মন্ত্রী ঐ  মিটিং-এ বনবিভাগের কর্মকর্তাদের তিরস্কার করেছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন গারোদেরকে ।যারা বনের মধ্যে বসবাস করে তাদের অধিকারই বেশি,” এমন কথাও বলেছেন বন ও পনি মন্ত্রী । একই মিটিং-এ উপস্থিত প্রতিমন্ত্রী এ.কে.এম মোশারফ হোসেন বলেছেবনবিনাশের জন্য বনবিভাগই দায়ী।
আদিবাসী গারোদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দমন করতে যে সবমিথ্যা মামলা    হয়েছিল তাও তুলে নেওয়ার কথা দিয়েছিলেন মন্ত্রী । ঐ মিটিং শেষে মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত  ছিল প্রাচীর হবে কিন্তু গারোদের অসুবিধা করে নয়। আর গারো  নেতারা সপ্তাহ। দুয়েকের মধ্যে একটি কমিটি করে বন বিভাগের সাথে কাজ করবে । কিন্তু মাস খানেক পরে কমিটি যখন হলো তখন গারোরা দ্বিধাবিভক্ত।  জুলাইয়ের চার তারিখে মন্ত্রীর সাথে মিটিং-এ যে সকল গারো নেতা (যেমন,  অজয় মৃ, প্রবিন চিসিম, থিউফিল নকরেক আরো অনেকে এখানে নাম উল্লখ করলাম না) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা সবাই বাদ ।  অভিযোগ, যে কমিটি শেষ পর্যন্ত হয়েছে তা সরকারের পছন্দ করা লোকজন নিয়ে । কমিটি ১২ সেপ্টেম্বর চুনিয়া কটেজে যে সভার আয়োজন করে তাতে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল দেয়াল নির্মাণসহ মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন । এরপর থেকে প্রাচীর বিরোধীদের সাথে সরকার ও সরকার-সমর্থক কমিটির বিরোধ চলছে ।বিরোধপূর্ণ এ সময়ে প্রাচীরের বিরুদ্ধে চলেছে মিছিল, মিটিং, কালো  পতাকা প্রদর্শন, ইত্যাদি । কিন্তু কেউ ভাবতে পারেনি বন প্রহরীরা এবং পুলিশ গুলি চালাবে নিরস্ত্র আদিবাসীদের উপর এবং আবারো প্রাণ হারাবে নিরীহ গারো ।

ঘটনার পর পর  দুটো মামলা হয়েছে। একটি করেছেন থানার ওসি মিছিলকারীদের “উচ্ছিৃখলআখ্যা দিয়ে। আরেকটি করেছেন থানার একজন হাবিলদার, বনপ্রহরীদের বিরুদ্ধে । থানার ওসির দাবি পুলিশ মিছিলকারীদের উপর  কোনো গুলি চালায়নি । শুধু বন প্রহরীরাই গুলি চালিয়েছে। গারোদের মধ্য থেকেও মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। গারো আদিবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাচীরের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে তা নানা কর্মসূচির মাধ্যমে অব্যাহত রাখায় বদ্ধ পরিকর তারা । তাদের এ প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গুরুত্ব অনেক । কারণ এর  মধ্য দিয়ে মধুপুরের অন্যান্য গুরুতর ব্যাপারে আরো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ তৈরি হয়েছে ।

মধুপুর আজ লন্ডভন্ড এক নষ্ট বনভূমি । বিদেশী অর্থে রাবার চাষ, বিদেশী প্রজাতি দিয়ে কৃত্রিম বনায়ন, কলা-আনারস-কাসাভা ইত্যাদির চাষ মধুপুরের প্রকতি, মাটি ও জীবজগত নষ্ট করে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। এসবের পরে প্রাচীর তলে বন রক্ষার যে চেষ্টা তা হাস্যকর। বনের মধ্যে পাকা প্রাচীরের যে তীব্র বিরোধিতা তা যদি অন্যান্য সর্বনাশা ঘটনার ব্যাপারেও ঘটত তবে মধুপুর শালবনের আজ আর এমন জীর্ণ দশা হয়তো হতো না । কাদতে হতো না বনবাসীকে । 

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post