ওয়ানগালা Wangala
গারোদের ঝুম চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে ক'টি সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠান রয়েছে তন্মধ্যে ওয়ানগালাই সর্বশেষ এবং সর্ববৃহৎ উৎসব। ঝুম ক্ষেতের সমস্ত ফসল তোলা হয়ে গেলে পরে গারোরা গ্রামওয়ারী অথবা কোন কোন সময় কয়েকটি গ্রাম একত্রে ওয়ানগালা উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। ওয়ানগালা উৎসব বিপুল জাঁকজমক সহকারে উদ্যাপিত হয় এবং কোন কোন সময় এই উৎসব সপ্তাহকাল পর্যন্ত চলে । গারোরা পারতঃপক্ষে ওয়ানগালা উৎসব উদ্যাপনের আগে ঝুম ক্ষেতে উৎপাদিত খাদ্যশস্য ব্যবহার করেনা। উৎসবের প্রস্তুতিতে গ্রামগুলি নূতন উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। গ্রামের আশেপাশে জঙ্গল, পথঘাট, নকপান্থে প্রভৃতি পরিস্কার করে গ্রামগুলোকে সুন্দর পরিপাটিরূপে সাজিয়ে তোলা হয় অক্টোবর মাসের শেষাংশে অথবা নভেম্বর মাসের মধ্যে ওয়ানগালা উৎসবটি উদ্যাপিত হয়ে থাকে। উৎসবের শুভদিন গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আখিং নক্মা নিজে নির্দিষ্ট করে দেন এবং যাতে গ্রামের লোকজন উৎসবের প্রস্তুতি ভালভাবে নিতে পারে, নূতন জামাকাপড় কিনতে পারে ও যথেষ্ট পরিমাণে পঁচুই মদ তৈরি করতে পারে সেজন্য উৎসবের বেশ কিছুদিন আগেই উৎসবের দিন তারিখ সকলকে জানিয়ে দেয়া হয়। দেশী পঁচুই মদ ওয়ানগালা উৎসবের অপরিহার্য্য অঙ্গ ।
|
ওয়ানগালা Wangala |
এক কথায় মদ ছাড়া এই উৎসব অর্থহীন । গ্রামের প্রতিটি পরিবার নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী প্রচুর পরিমাণে মদ তৈরি করে এবং আখিং নক্মা সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত করে থাকে। কোন কোন সময় আখিং নক্মা প্রতিটিতে পাঁচ কেজি চালের ভাত ধরে এমন বৃহদাকার জালার (দিক্কা) দশ পনেরোটি জালা মদ তৈরি করে। উৎসবের প্রারম্ভে প্রতিটি পরিবার নিজ নিজ বসতবাড়ির সামনে কলাপাতায় করে ঝুম ক্ষেতে উৎপাদিত সকল প্রকার শস্যের কিছু কিছু পরিমাণ সাজিয়ে দেবদেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনার মাধ্যমে উৎসর্গ করেন। ঐ উৎসর্গীকৃত শস্যগুলির উপরিভাগে দ্বিখণ্ডিত পাকা চাল কুমড়া রাখা হয়। সেখানে ধূপধূনাসহ প্রদীপ জ্বালানো থাকে এবং সেই সঙ্গে পরিবারের মূল্যবান সম্পদগুলো এবং রাং সে স্থানে সাজিয়ে রাখা হয় । গারো সমাজে রাং অথবা গং মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত এবং যে পরিবারে যত বেশি রাং তাকে সে পরিবারই তত সম্পদশালী হিসেবে বিবেচিত হয়। সে জন্যই গারো সমাজে বংশ পরম্পরায় রাং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। রাং কাঁসা নির্মিত বৃহৎ গামলা আকারের এক প্রকার পাত্র এবং বাইরের সমাজে এর মূল্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয় । ধূপধূনা পুড়িয়ে এবং সেই সঙ্গে প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের যে সূচনা করা হয় তাকে সাসাত্সুআ (ধূপ পুড়ানো) বলা হয় এবং এর পরেই আসল উৎসব শুরু হয়।
ওয়ানগালা উৎসবের প্রথম দু'দিন যথাক্রমে ‘চুরুগালা’ অথবা সংক্ষেপে ‘রুগালা’ এবং ‘গাকাতা' নামে পরিচিত । রুগালার দিনেই নাচ এবং মদ্যপান শুরু হয় কিন্তু ঐদিনে লোকজনেরা নূতন কোন অলংকার পরেনা অথবা মোরগের লম্বা পালক তাদের পাগড়ীতে গুঁজেনা । ঐ দিনই বিকেলে শূকর ও গরু মেরে সেগুলোর মাংস গ্রামবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। গ্রামবাসীরা যদি নিতান্ত গরীব হয়ে থাকে তবে তারা চাঁদা তুলে একত্রে বড় শূকর কিংবা গরু কেনে এবং রুগালার দিনে সেটি হত্যা করে মাংস ভাগাভাগি করে নেয়।
|
ওয়ানগালা Wangala |
অবস্থাপন্ন পরিবারেরা নিজেদের জন্য শূকর অথবা গরু মারে এবং সেগুলোর মাংস নিজেদের জন্যে কিছু পরিমাণে রেখে বাদবাকি মাংস গরীব প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। ওয়ানগালা উৎসব প্রত্যক্ষ করতে গ্রামান্তর হতে আসা অতিথিদের সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে অত্যন্ত সম্মান এবং যত্নসহকারে ভূড়িভোজনে আপ্যায়িত করা হয়। ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে আখিং নক্মার বাড়িতেই প্রথম নাচ শুরু হয় । প্রথম দিকে সাধারণতঃ মেয়েরাই নৃত্য পরিবেশন করে এবং পুরুষেরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নৃত্যের তালে তালে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকে । নৃত্যের প্রারম্ভে আখিং নক্মা বেশ কিছু পরিমাণ ভাত তার ঘরের ভেতরে এবং বাইরে ছড়িয়ে দেন এবং সেই সঙ্গে চু বিচ্ছিও (মদ) ঢেলে দেন।
নৃত্য পরিবেশনকারী দল উক্ত ছড়ানো ভাত ও মদ মাড়িয়ে নাচতে আরম্ভ করে। এভাবে গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে দিনরাত নাচ চলতে থাকে । এই ওয়ানগালা উৎসবের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন নামের বিভিন্ন ভঙ্গীর নাচ পরিবেশিত হয় এবং সেগুলির প্রতিটিই যথেষ্ট অর্থবহ ও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ ।
নিচে নাচগুলির বর্ণনা দেয়া গেল।
গ্রং দক্আ (শিং বাজানো) :
ওয়ানগালা উৎসবের নাচের সুচনায় এই নৃত্য পরিবেশিত হয়। উৎসবের মধ্যমণি আখিং নক্মা এক হাতে মিল্লায় (তরবারী) এবং অপর হাতে স্পী (ঢাল) নিয়ে ধীর লয়ে ‘আহাওয়া শব্দোচ্চারণের মাধ্যমে এই নৃত্য পরিবেশনের সূচনা করেন। সে সময় বাদ্যযন্ত্ৰ সমূহ মৃদুস্বরে বাজতে থাকে । এই নাচের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে সবাইকে আহবান জানানো ‘এসো আমরা নাচি, এসো আমরা গাই” ।
_দক্রু সু-আ (ঘুঘু পাখির লড়াই) :
এই নাচের অর্থ “বন্য ঘুঘু পাখির মত নিরীহ প্রাণীরাও ক্ষতিকর প্রভাব হতে নিজেদের অধিকারকে রক্ষার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে” । এ নাচে মেয়েরা পরস্পরের মুখোমুখী দুইটি সারিবদ্ধাবস্থায় পরস্পরকে আক্রমণের ভঙ্গীতে বাজনার তালে তালে ধীর লয়ে নাচে ।
পুরাতা রাত্তা (উঁচুতে লম্বমান শস্যের শীষ সংগ্রহ করা) :
এই নাচের অর্থ “সময় থাকতে জীবনের মূল্যবান সম্পদ সমূহ সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকা ।” এ নাচে মেয়েরা এক সারিতে বাজনার তালে তালে নাচতে থাকে এবং উঁচু হতে কোন কিছু সংগ্রহ করার ভঙ্গী দেখায়।
অপিং রাত্তা (আগাছার মূলোৎপাটন) :
এই নাচের সময় মেয়েরা তাদের বিপরীতে সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান ছেলেদের দিকে নাচের ভঙ্গীতে অগ্রসর হয়ে হাতের সাহায্যে ছেলেদের মাথার পাগড়ী কেটে ফেলার ভান করে ।
৫. আজেমা রুআ (পথ প্রদর্শনী নৃত্য) :
এই নাচে মেয়েরা চলতি পথে ছেলেদের হ'তে এগিয়ে গিয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচের ভঙ্গীতে পথ চলে । রুয়ে আমা (প্রবীণ প্রবীণা সেজে তরুণ তরুণীদের নৃত্য) : এই নাচে মেয়েরা মাথায় ঘোমটা টেনে প্রবীণা সেজে নাচতে থাকে এবং ছেলেরা প্রবীণ সেজে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকে ।
দামা জাজকা (দামা পরিবর্তন) :
এই নাচে দামা পুরুষ বাজিয়েরা প্রচণ্ড শব্দে তাদের দামা বাজিয়ে থাকে এবং পরস্পর পরস্পরের দামা পরিবর্তন করে।
|
ওয়ানগালা Wangala |
মাত্মানা জেং অন্না (মহিষকে ঘাস খাওয়ান) :
এই নাচে পুরুষ নাচিয়েরা তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে মেয়ে নাচিয়েদের দিকে এগিয়ে যায় এবং মেয়ে নাচিয়েরা তাদের হাতের মুঠিতে ঘাস ধরার ভঙ্গীতে পুরুষ নাচিয়েদের দিকে তুলে ধরে।
আমব্রেতং মূজেকা (আমড়া গাছ ঝাঁকানো) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা একটি বাঁশের খুঁটিকে মাঝখানে রেখে বাজনার তালে তালে নাচে এবং পর্যায়ক্রমে বাঁশের খুঁটিটিকে ঝাঁকানোর ভঙ্গী করতে থাকে।
১০. নমিল্ দোমি সুআলা (তরুণীদের মোরগের পালক বিতরণ) :
এই নাচে মেয়েরা তাদের হাতে মোরগের লম্বা পালক নিয়ে সারিবদ্ধভাবে নাচতে থাকে এবং পুরুষ বাজিয়েরা তাদের দিকে এগিয়ে আসলে তাদের মাথার পাগড়ীতে সেটি গুঁজে দেয়।
১১. নমিল পান্থে সাল্লিদিংআ (তরুণ তরুণীর পরস্পরকে আকর্ষণ) :
এই নাচে পুরুষ নাচিয়েরা মৃদু বাজনার তালে তালে সারিবদ্ধভাবে নাচতে থাকে এবং মেয়ে নাচিয়েরা তাদের পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সমতালে নাচতে থাকে এবং নাচের ফাঁকে ফাঁকে তাদের সম্মুখস্থ পুরুষ নাচিয়েদের পিছনে লম্বমান কাপড়ের অগ্রভাগ ধরে আকর্ষণ করে।
১২. নমিল্ কাসাং দয়ে রিংআ (তরুণী কর্তৃক গোপনে ধূমপান) :
এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা পুরুষ বাজনদারদের মৃদু বাজনার তালে তালে তাদের ঘোমটার আড়ালে রেখে ধূমপানের ভঙ্গীতে নাচতে থাকে ।
১৩. সালাম কা’আ (নমস্কার জানানো) :
মেয়ে নাচিয়েরা এই নাচটিতে নাচের তালে তালে মাথা সামান্য নত করে ডান হাত উপরে ওঠিয়ে পুরুষ বাজনদারদের প্রতি নমস্কারের ভঙ্গী করে।
১৪. বারা সুগালা (কাপড় ধোয়া) :
এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা তাদের কাপড় যেন অপরিচ্ছন্ন এই ভান করে কাপড় কাঁচার ভঙ্গীতে নাচতে থাকে ।
১৫. দোসিক্ মেগারো চাআ (টিয়া পাখি কর্তৃক যবের শীষ আহার) :
এই নাচে পুরুষ নাচিয়েরা নাচের তালে তালে নাচিয়েদের দিকে এগিয়ে এসে তাদের মাথায় টিয়া পাখির মত ঠোকর দেয়ার ভঙ্গী করে। এর জবাবে মেয়েরা নাচের তালে তালে পিছু হটে যায় এবং আবার এগিয়ে আসে।
১৬. দামা জংআ (সমান্তরালভাবে দামা সাজানো) :
এই নাচে পুরুষ বাজনদারেরা নাচের তালে তালে তাদের হাতের দামাগুলো পরস্পর সমান্তরালভাবে সাজায় আবার তৎক্ষণাৎ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনে এবং মেয়ে নাচিয়েরা তাদের এই ভঙ্গীতে আনন্দ প্রকাশ সহকারে কিছু দূরত্বে অবস্থান পূর্বক নিজস্ব ভঙ্গীতে নাচতে থাকে ।
১৭. সিপাই আবিত রুআ (সিপাই কর্তৃক ড্রাম বাজানো) :
এই নাচে মেয়েরা বৃত্তাকারে নাচে এবং পুরুষ বাজনদারেরা তাদের বহির্ভাগে বৃত্তাকারে বাজনার তালে তালে ঘুরে নাচতে থাকে ।
১৮. নমিল খাম্বি থুআ (তরুণী কর্তৃক উচ্চতা মাপা) : এই নাচে মেয়েরা পরস্পরের দিকে নাচের তালে তালে এগিয়ে আসে এবং পরস্পরের উচ্চতা
মাপার ভঙ্গী করে নাচতে থাকে।
১৯. চাম্বিল মেসাআ (চাম্বল ফলের নাচ) : এই নাচে পুরুষ নাচিয়েরা তাদের পিছনে চাম্বল ফল লম্বা কাপড়ে কোমরের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে মাথা নীচু করে কোমর দুলিয়ে নাচতে থাকে এবং নাচের তালে তালে পিছনে ঝুলানো চাম্বল ফলটি চক্রাকারে ঘুরতে থাকে এবং মেয়ে নাচিয়েরা দূর হতে সেটি ধরার ভঙ্গীতে নাচতে থাকে ।
২০. আমাক্ মিখপ্ চাআ (বানর কর্তৃক ভূট্টা আহার) : এই নাচে ছেলে নাচিয়েরা দলবদ্ধভাবে নাচতে নাচতে বানরের ভঙ্গীতে উঠানে সংরক্ষিত শস্য দানার চারপাশে ভীড় জমাবে এবং খাওয়ার ভান করবে। ইত্যবসরে মেয়ে নাচিয়েরা দলবদ্ধভাবে নাচতে নাচতে তাদের দিকে এগিয়ে এসে তাড়াবার ভান করবে এবং ছেলেরাও ভয় পাওয়ার ভঙ্গীতে দ্রুত বেগে নাচতে নাচতে দূরে সরে
যাবে।
২১. আমব্ৰেতং খল্লা (আমড়া কুড়ানো) : এই নাচে ছেলে এবং মেয়ে নাচিয়েরা দলবদ্ধভাবে একটা বাঁশের খুঁটিকে মাঝখানে রেখে নাচবে এবং মাঝে মাঝে নীচু হয়ে কোন কিছু কুড়ানোর ভঙ্গী করবে।
২২. নমিল্ জাজং নিদুআ (তরুণী কর্তৃক চাঁদ দেখা) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা নাচতে নাচতে পরস্পর দলচ্যূত হয়ে অন্যমনস্কভাবে উর্ধ্বপানে তাকিয়ে চাঁদ দেখার ভঙ্গীতে নাচতে থাকবে এবং পুরুষ বাজনদাররা তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাবে। ২৩. খিল্ পুআ (তূলা বীজ বপন) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা পরস্পর দলচ্যূত
হয়ে বাজনার তালে তালে দ্রুতলয়ে পা ফেলে নাচতে থাকবে এবং নাচের ফাঁকে ফাঁকে সামনের দিকে ঝুঁকে কোন কিছু বপনের ভঙ্গী করবে। ছেলে নাচিয়েরা ঐ সময়ে তালে তালে বাজনা বাজিয়ে মেয়েদের নাচের তারিফ করবে।
২৪. নমিল্ চাকোরী গাথিমাংআ (তরুণী কর্তৃক উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারী) : এই নাচে একটি নাচিয়ে তরুণী দলচ্যূত হয়ে একাকী উদ্দেশ্যহীনভাবে নাচতে থাকবে এবং এমন ভাব দেখাবে সে যেন কোন কারণবশতঃ পৃথিবী এবং সেই সঙ্গে নিজের জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলেছে। ইত্যবসরে অন্যান্য সঙ্গী তরুণী নাচিয়েরা এবং পুরুষ বাজনদারেরা বাজনার তালে তালে তরুণীটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে ঘিরে নাচতে থাকবে এবং তার সম্বিত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
২৫. চু খান্না (মদ খাওয়ানো) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা মদ ভর্তি ফং (লম্বা চিকন হাতা বিশিষ্ট লাউ) হাতে সারিবদ্ধভাবে বাজনার তালে তালে নাচতে থাকবে এবং নাচতে নাচতে এগিয়ে গিয়ে সারিবদ্ধ পুরুষ বাজনদারদের মদ ভর্তি ফং হতে একেক ঢোক করে মদ খাইয়ে পূর্বাবস্থানে ফিরবে এবং এভাবে নাচ চলতে থাকবে ।
২৬. চামে চাংআ (প্রেমিকাকে অনুসরণ) : এই নাচে একটি নাচিয়ে তরুণী নিজ দল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে নাচতে নাচতে একাকী এগিয়ে যাবে এবং একটি নাচিয়ে তরুণ তার কাঁধে ঝুলানো দামা বাজাতে বাজাতে নাচের তালে তালে তাকে অনুসরণ করবে। কিছু দূর এভাবে অগ্রসর হওয়ার পর তরুণ তরুণীদ্বয় আবার পূর্বাবস্থানে ফিরে আসবে। তখন অন্যান্য নাচিয়েরাও একের পর একজন ঐভাবে নাচবে ।
২৭. অগাল রুয়া (উনুনের উপরের মাচা খুলে ফেলা) : এই নাচে ছেলে এবং মেয়ে নাচিয়েরা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে বৃত্তাকারে অবস্থান করে উপরের দিকে হাত বাড়িয়ে কোন কিছু খুলে ফেলার ভঙ্গী করে নাচবে ।
২৮. মাত্মা সিআকু শগিন চাআ (শকুন কর্তৃক মৃত মহিষ আহার) : এই নাচে একজন পুরুষ নাচিয়ে তার দামা বাজাতে বাজাতে তালে তালে নেচে দল ছেড়ে একটু দূরে হাঁটু গেড়ে বসবে এবং তার দামা বাজাতে থাকবে। ইত্যবসরে মেয়ে নাচিয়েরা দলবদ্ধভাবে নাচতে নাচতে এগিয়ে এসে বৃত্তাকারে তাকে ঘিরে হাত বাড়িয়ে আক্রমনের ভঙ্গী করবে এবং দলের অন্যান্য পুরুষ নাচিয়েরা তাদেরকে ঘিরে বাজনার তালে তালে নাচবে। ২৯. দামা বারাত সাক্রিংআ (দামার ছাউনী টান টান করে তোলা) : এই নাচে পুরুষ নাচিয়েরা মেয়ে নাচিয়েদেরকে ঘিরে নাচতে থাকবে এবং নাচের ফাঁকে ফাঁকে তাদের দামার ছাউনী কষে বাঁধার ভঙ্গী করবে।
৩০. জিক্ সেক্আ (স্ত্রী হরণ) : এই নাচে একজন পুরুষ নাচিয়ে তার দামা বাজিয়ে নাচের তালে তালে তার দল ছেড়ে একাকী মেয়ে নাচিয়েদের সারির দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে যে কোন একজন মেয়ের হাত আকর্ষণের ভঙ্গী করবে । মেয়েটি যদি এতে আপত্তি না জানায় তবে সে নিজ সারি হতে বাইরে এগিয়ে আসবে এবং নাচতে নাচতে উভয়ে পাশাপাশি কিছু দূরে চলে যাবে । ঠিক একইভাবে দলের অন্যান্যরাও একের পর একজন তাদেরকে অনুসরণ
করবে।
৩১. জিক্ সেক্আকু রিআ (স্ত্রী হরণকারীকে ধৃত) : এই নাচে একজন তরুণ নাচিয়ে ও একজন তরুণী নাচিয়ে দলত্যাগ করে নাচতে নাচতে উভয়ে একত্রে অগ্রসর হলে তাদের দলের অন্যান্যরা এক সঙ্গে তাদের পশ্চাদ্ধাবন
করে ঘিরে ফেলে এবং নাচতে নাচতেই তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ভঙ্গী
করে।
৩২. গাওয়েংআং রোআ (উঁচু কদমে নৃত্য) : এই নাচে তরুণীরা বাজনার তালে তালে দ্রুতবেগে এবং জোরে জোরে লম্বা পা ফেলে সারিবদ্ধভাবে নাচতে
থাকে।
৩৩. দোমি গংআ (মোরগের লেজ নোয়ানো) : এই নাচে মেয়েরা সারিবদ্ধভাবে মৃদু মৃদু পা ফেলে নাচতে থাকে এবং তাদের বিপরীত সারিতে দণ্ডায়মান ছেলেরা নাচতে নাচতে মেয়েদের দিকে মাথা নুইয়ে তাদের পাগড়ীতে পূজা
মোরগের পালক দোলাতে থাকে ।
৩৪. মাবিল রোআ (ভালুকের নৃত্য) : এই নাচে পুরুষ নাচিয়েরা তাদের দামা সজোরে বাজিয়ে উদ্দামভাবে নাচতে থাকে এবং মেয়ে নাচিয়েরা কিছু দূরে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে তাদের নিজস্ব ভঙ্গীতে মৃদু মৃদু লয়ে পা ফেলে নাচতে
থাকে ।
৩৫. খিল্ অআ (তুলা সংগ্রহ) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচতে নাচতে পরস্পর দলচ্যূত হয়ে নাচের তালে তালে হাতের সাহায্যে কোন কিছু সংগ্রহের ভঙ্গী করে এবং পিছনের ঝুড়িতে সেটি রাখার ভান করে। এভাবে কিছুক্ষণ নাচার পরে আবার পরস্পর সারিবদ্ধ হয়ে নাচতে নাচতে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে, যাতে মনে হয় তারা তুলা সংগ্রহ শেষে বাড়ি ফিরছে
৩৬. নমিল্ বারা দনুয়া (তরুণী কর্তৃক কাপড় লুকানো) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা সারিবদ্ধভাবে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচতে নাচতে পুরুষ বাজিয়েদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদের দামায় গুঁজে রাখা কাপড়ের টুকরা চুপিসারে হস্তগত করে নাচের তালে তালে পিছু হটে আসবে এবং পুরুষ বাজনদারেরা পরে সেটি টের পাওয়ার ভান করে সামনে তাড়িয়ে আসার ভঙ্গী করবে এবং মেয়েদের হাত হতে সেটি কেড়ে নেয়ার ভঙ্গী করবে। ৩৭. এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা সারিবদ্ধভাবে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচতে নাচতে তাদের বিপরীতে সারিবদ্ধ দণ্ডায়মান পুরুষ নাচিয়েদের অন্যমনস্কতার সুযোগে তাদের পিছনে চলে যাবে এবং সেখানে কিছুক্ষণ নাচার পরে আবার মৃদুমন্দ পায়ে নাচের তালে পূর্বাবস্থানে ফিরে আসবে।
৩৮. মেমাং মি সুআ (ভূত-পেত্নী কর্তৃক ধান ভানা) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা নাচের তালে তালে তাদের দল হতে দু'জন করে বাইরে এসে উঠানে রাখা ঝুড়ি এবং তদুপরি রাখা বাঁশের সাহায্যে নৃত্যের তালে তালে ধান ভানার ভঙ্গী করবে এবং ইত্যবসরে পুরুষ বাজনদারেরা তাদেরকে বৃত্তাকারে ঘিরে
বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকবে ।
৩৯. চাম্বিল্ গুআ (চাম্বল ফল নিক্ষেপ) : এই নাচে পুরুষ নাচিয়েদের পিছনস্থিত লম্বমান কাপড়ে চাম্বল ফল বেধে রাখা হয় এবং বাজনার তালে তালে নাচের সময় সেটি দোলাতে থাকে, আর মেয়ে নাচিয়েরা হাতের সাহায্যে সেটি ধরে
৪০.
এবং পুনরায় নিক্ষেপের ভঙ্গী করে।
নমিল্ মিথাং দনুয়া (তরুণীর মুখ লুকানো) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা কাপড়ের সাহায্যে তাদের নিম্নোষ্ঠ লুক্কায়িত রেখে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে সারিবদ্ধভাবে নাচতে থাকবে এবং তাদের বিপরীতে সারিবদ্ধ দণ্ডায়মান পুরুষ বাজনদারেরা মেয়েদের নাচের এ দৃশ্য দেখে যেন বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে এমন ভান করে বাদ্যযন্ত্র অন্যমনস্কভাবে বাজাবে ।
৪১. চাম্বিল্ দেআ (চাম্বল গাছ কাটা) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা বাজনার তালে তালে নাচতে নাচতে পুরুষ নাচিয়েদের দিকে এগিয়ে যাবে এবং পুরুষ বাজনদারদের দামার উপরিভাগে হাতের তালুর সাহায্যে গাছ কাটার মত
ভঙ্গী করবে।
৪২. বারা ওয়াগংউ রামা (শূন্যে ঝুলানো বাঁশে কাপড় শুকানো) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে দুই হাত শূণ্য পানে উঠিয়ে কাপড় শুকানো এবং নাড়া চাড়ার ভঙ্গী করবে এবং পুরুষ নাচিয়েরা তাদেরকে ঘিরে নাচের তালে তালে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকবে।
৪৩. গায়ে রুআ (তরুণী কর্তৃক হাঁটু গাড়া) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা পুরুষ বাজনদারদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মৃদুমন্দ পায়ে নাচতে থাকবে এবং পুরুষ নাচিয়েরা তদ্রুপ সুন্দর ভঙ্গীতে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে নাচবে। ৪৪. বুদু রাতেত্তা (লতা ছিন্ন করা) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচতে নাচতে সামনে এগিয়ে যাবে এবং দেখতে পাবে যে তাদের সামনে দুই পুরুষ নাচিয়ে পরস্পর সমান্তরাল অবস্থানে রজ্জুবদ্ধাবস্থায় বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। তখন মেয়ে নাচিয়েরা তাদের গমন পথের বাধা সেই রজ্জুটিকে হাতের তালুর সাহায্যে কেটে ফেলার ভঙ্গী করবে এবং তালে তালে নাচতে থাকবে ।
৪৫. নমিল্ নিপিল্আ (তরুণীর পিছন ফিরে তাকানো) : এই নাচে মেয়ে নাচিয়েরা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচতে নাচতে সামনে এগিয়ে যাবে এবং কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে নাচের তালে তালেই ঘাড় বাঁকিয়ে পিছন ফিরে তাকাবে এবং পুরুষ নাচিয়েরাও নাচের তালে তালে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকবে। ৪৬. চাওয়ারী সিআ (জামাই ধরা) : এই নাচে একজন পুরুষ নাচিয়ে তার দল হতে বের হয়ে দামা বাজাতে বাজাতে একাকী নাচতে থাকবে এবং ঐ সময়ে মেয়ে নাচিয়ের দল হতে একটি মেয়ে নাচিয়ে বের হয়ে এসে অন্যত্র একাকী নাচতে থাকবে এবং নাচের ফাঁকে ফাঁকে একাকী পুরুষ নাচিয়ের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করবে। তার এই অঙ্গুলী নির্দেশকে অনুসরণ করে পুরুষ নাচিয়ের দল সেই পুরুষটিকে ঘিরে ফেলবে এবং বাদ্যযন্ত্র সজোরে বাজিয়ে নাচতে নাচতে তাকে পূর্বাবস্থানে ফিরিয়ে আনবে। সেখানে মেয়ে পুরুষ সম্মিলিতভাবে নূতন উদ্যমে নাচ আরম্ভ করবে। ইত্যবসরে দর্শকের দল
তাদেরকে মদ ও মাংসের কাজি (চাট) পরিবেশন করবে।
ওয়ানগালা উৎসবের মাধ্যমে গারোরা মূলতঃ তাদের প্রধান আরাধ্য দেবতা তাতারা রাবুগা-নস্তু-নপান্তু এর প্রতি সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানায়। কারণ তিনিই সময় মত মর্ত্যধামে বারিবর্ষণ করে, ঋতু চক্র স্বাভাবিক নিয়মে আবর্তিত করে ফুলে ফলে। ফসলে এই বিশ্ব চরাচরকে সুসমৃদ্ধ করে তোলেন এবং মানুষের সুখী সমৃদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করেন। কাজেই তার এই মহান দানের বিনিময়ে তাঁরই দানের সামান্য পরিমাণ উত্তমাংশ দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা এবং আগামী বছরের জন্য আরোও ভাল ফসলের আবেদন জানানোকে গারোরা স্বাভাবিকভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে করে থাকেন। একই সঙ্গে ফসল তোলার পরে তাদের ঘরে যে প্রাচুর্য্যের সম্ভার সেই প্রাচুর্য্যকে সবান্ধবে সন্মিলিতভাবে পানাহারে উপভোগ করাও ওয়ানগালা উৎসব পালনের অন্যতম কারণ। তবে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্রষ্টাকে তথা তাতারা রাবুগা-নঙ্গু-নপান্তুকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, তাঁর আশীর্বাদ যাচ্না এবং আগামী দিনের জন্য উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা।
ওয়ানগালা উৎসবে কেবল মাত্র নাচই পরিবেশিত হয়না নেই সঙ্গে দরুআ, রে-রে, আজিয়া প্রভৃতি লোকগীতিও পরিবেশিত হয়ে থাকে। বিশেষতঃ ওয়াল্জাং ও সেরেন্জিং নামীয় তরুণ তরুণীর অমর প্রেমগাঁথা সে সময় পালাগানের আকারে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এখানে একটা কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, কেবলমাত্র ওয়ানগালা উৎসবেই নাচ-গান পরিবেশিত হয়না। ওয়ানগালা উৎসব ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন গান্না, দেবিসিয়া, আসং-কুশি- টাট্টা, জাঅক্কা, দাগিপা-আমুয়া, আচুরা-কৃতা, মাং-অন্না, আকৃতা, রংচু- গাল্লা, মিক্চি-সক্চি-দানা প্রভৃতি অনুষ্ঠানেও বিভিন্ন নাচ বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিবেশিত হয়ে থাকে। অবশ্য সেগুলোর পরিবেশন ভঙ্গী এবং মর্মকথা একটু ভিন্নতর। বিশেষজ্ঞদের মতে গারো সংস্কৃতির উৎস প্রাক্ বৌদ্ধযুগে এবং এর প্রথম চর্চা বর্তমানের তিব্বতে যার বিকাশ সাধন হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমনের পর। বিভিন্ন উৎসবে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে, দেবদেবীর উপাসনায়, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যেসব বাদ্যযন্ত্র গারোরা ব্যবহার করে সেগুলোর গড়নে এবং বাদন পদ্ধতিতে প্রাচীণ একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। গারোদের বিশ্বাস প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার বাণী প্রকাশ পায়। আপাতঃ দৃষ্টে গারো নাচকে একই পদ্ধতিতে ধীর লয়ে পা ফেলার অনুশীলন মনে হতে পারে, কিন্তু বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে নাচের যে ভঙ্গী প্রকাশ পায় তাতে এক গভীর ব্যঞ্জনাময় অর্থ মূর্তমান হয়ে ওঠে। শান্ত সমাহিত চিত্তে গভীর অভিনিবেশ সহকারে কেউ যদি প্রতিটি গারো নৃত্য পর্যবেক্ষণ করে তবেই সেগুলির প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করা যাবে।
সেই সঙ্গে মদ্যপান চলে । এদিন জনসাধারণ যে যার ইচ্ছেমত ভোজন পান করে। ওয়ান্গালার দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ‘গাকাতের’ দিন প্রচুর পরিমাণে ভোজন ও অতিথি অভ্যাগতদেরকেও প্রচুর পরিমাণে পান ভোজনে আপ্যায়িত করা হয়। মেয়েরা অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করেনা । কারণ অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং দেখা শোনার দায়িত্ব তাদের। অতএব মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে মাতাল হয়ে পড়ে থাকলে তাদের চলেনা । গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নাচ পরিবেশন শেষ হলে পরিবেশনকারী দল আবার আখিং নক্মার গৃহে ফিরে আসে এবং সেখানেই শেষ পানভোজন চলে। এভাবে বৎসরের সর্ববৃহৎ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব ওয়ানগালার পরিসমাপ্তি ঘটে। ওয়ানগালা উৎসবে নাচে অংশগ্রহণের সময়েই অনেক তরুণ তরুণী তাদের মত দেয়া নেয়া করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ পছন্দমত বর অথবা কনে নির্বাচন করে থাকে। ওয়ানগালা উৎসব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতি বৎসরের জন্যে ঝুমচাষ কেন্দ্রিক যাবতীয় অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আদিবাসী জীবনধারা মানেই সাংস্কৃতিক জীবন এবং গারোরাও কোন দিক দিয়ে এর ব্যতিক্রম নয় । আগেকার দিনে গারোদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ছিল সাংস্কৃতিক তৎপরতায় সমৃদ্ধ । জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, কৃষিকর্ম সমস্ত কিছুতেই সাংস্কৃতিক তৎপরতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল । আর সেসব সাংস্কৃতিক তৎপরতার মূল উৎসই ছিল সামাজিক লোকাচারের অনুপ্রেরণা। গারোদের মধ্যে সন্তান জন্মদানও কেবলমাত্র পিতা মাতার আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না বরং গ্রামবাসীরা সকলে একে নিজেদের আনন্দ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। পরিবারে কোন মহিলা সন্তান সম্ভবা হওয়ামাত্র চু-জাঙ্গি (জীবন-মদ) প্রস্তুত শুরু হয়ে যায়, যে চু-জাঙ্গি শিশুজন্মের দিনে গ্রামবাসী সকলে মিলে উপভোগ করে। আগেকার দিনে নানাবিধ আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রসূতি জাতক উভয়ের মঙ্গল কামনা করা হতো এবং সুখের কথা ঐ বিজ্ঞানবর্জিত যুগেও গারো সমাজে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কম ছিল। আবার অন্যদিকে গারো বিবাহকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত আচার অনুষ্ঠান, লৌকিকতা আগেকার দিনে চালু ছিল এবং বর্তমানেও চালু রয়েছে সমাজ জীবনকে সুসংবদ্ধ রাখার জন্য সেগুলির অবদানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । গারো বিবাহ কেবলমাত্র ব্যক্তি নারী পুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এর ব্যাপ্তি সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। খিম্ প্রথার মাধ্যমে গোত্র উপগোত্র তথা সমাজ নরনারীর বৈবাহিক জীবনকে স্বীকৃতি দেয় । সোজা কথায় খিম্ প্রথার মাধ্যমে সমাজ বৈবাহিক জীবনের যে কোন দুঃসময়ের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে । আগেকার দিনে কৃষিকাজ তথা ঝুমচাষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সাংস্কৃতিক তৎপরতার
বর্ষ পরিক্রমা। সাংস্কৃতিক তৎপরতার সেই বর্ষ পরিক্রমা চলতো আগাল্-মাক্কা হতে আরম্ভ করে ওয়ানগালা উৎসব পর্যন্ত । মৃত্যুও গারোদের সামাজিক সংস্কৃতিতে এক গভীর প্রভাব ফেলে থাকে । মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে সব লোকাচার আগেকার দিনে অনুষ্ঠিত হত সেই সবের মাধ্যমে গারোদের ধর্মবিশ্বাসের পাশাপাশি প্রকাশ পেতো মৃতদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ এবং বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর মমত্ববোধ । শ্রাদ্ধ ক্রিয়াদির সঙ্গে সম্পর্কিত পানাহার ছিল সেখানে বাহ্য । গারোদের প্রধান উৎসব ওয়ানগালার কথাই ধরা যাক । এই ওয়ানগালা উৎসব ছিল গারোদের জীবনে এক অনন্য আনন্দ উদযাপনের দিন, সার্বজনীন মিলন মহোৎসবের দিন। সারা বৎসরের কর্মক্লান্ত, অবসাদগ্রস্থ দেহ মন এই উৎসবের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকতো। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা উন্মুখ হয়ে থাকতো মন দেয়া নেয়ার পালা সাঙ্গ করার আশায়, গরীবেরা থাকতো ইচ্ছেমত পেটপুরে ভাল-মন্দ পান ভোজনের আশায়, প্রবীণ প্রবীণারা থাকতেন অতীতের সুখ স্মৃতি রোমন্থনের আশায়। এক কথায় এই ওয়ানগালা উৎসব ছিল গারোদের নিকট এক পরম কাংখিত দিন যে দিনটিতে শুধু পানভোজনই নয়, শুধু নাচ গানই নয়, শুধু ধর্মাচরণই নয়, সেই সঙ্গে থাকতো সামাজিক মেলামেশার এবং পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের এক সুবর্ণ সুযোগ। আজ সময়ের ব্যবধানে হয়তোবা সেই সব উৎসব এবং সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক তৎপরতা ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে বসেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু যে কোন ধর্মীয় উৎসব আয়োজনে, সামাজিক প্রয়োজনে সম্মিলিত সহযোগিতা, সম্মিলিত অংশগ্রহণ আজোও গারোদের মাঝে সুলভ। এক্ষেত্রে গারোরা এখন পর্যন্তও সর্বপ্রকার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে এবং উহাই হচ্ছে গারোদের সামাজিক লোকাচারের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
Help of Books
1.Rongmuthu Dewan Sing :The Folk Tales of The Garos, Dept of the Publications Gauhati University.
2.Dr. Sangma Milton : History cultur of the Gaors Books today New Dhlhi.
3. Gasshl S. : Garo Hils Land and people Omsons Publications, New Delhi.
4.Plyfair A Major: The Garos United Publications, Pan Bazer Guahati781001
5. Bahttaharjee JB: The Garos and the English Radiant Publication New Delhi.
6.Dr. Sinha TC: The Psyche of the Gaors. Anthropological Survey of India Calcutta.
7.Mackenzie Alexander : The North Ease Frontier of India. Mittal Publications Delhi-110035.
8.Dr Majumder DN:Culture Change in two Garo Villages. Anthropological Survey of India Calcutta.
9.Dr. Burling Robbins: Rengsanggri Philadelphia University of Pennsylvania Press
10. Sing K.S. The Schedule Tribes. Oxford University Press Calcutta.
11. Marak Julius: Garo Customery Law and Practices. Farma KLM Private Ltd, Calcutta.
Wangala
Wangalai is the last and largest of the many social festivals associated with Jhum cultivation of the Garos. After all the crops of the jhum fields are harvested, the Garora gramwaris or sometimes several villages together celebrate the Wangala festival. The Wangala festival is celebrated with great pomp and sometimes lasts for a week. The Garos may not consume the food grains produced in the Jhum fields before the Wangala festival is celebrated. Villages are energized with renewed enthusiasm in preparation for the festival. The Wangala festival is celebrated around the end of October or in the month of November. The auspicious day of the festival is fixed by Akhin Nakma himself in consultation with the elders of the village, and so that the people of the village can prepare for the festival well, buy new clothes and make enough Panchui wine, the date of the festival is announced to everyone a few days before the festival. Desi Panchui liquor is an essential part of Wangala festival. In a word, this festival is meaningless without alcohol. Each family in the village produces a large amount of liquor according to their means and Akhin Nakma prepares the most. Sometimes the Akhin Nakma makes ten to fifteen jalas of large nets (dikka) each holding five kilograms of rice. At the beginning of the festival, each family arranges some quantity of all kinds of crops produced in the Jhum field on a banana leaf in front of their homestead and offers it to the gods and goddesses through prayers. On top of the consecrated grains are split ripe rice gourds. Lamps with incense are lit there and the family's valuables and colors are arranged there. Rang or gong is considered a valuable asset in Garo society and the more Rang a family has, the wealthier the family. That is why in the Garo society, color is carefully preserved as a family property from generation to generation. Rang is a type of large vase-shaped vessel made of bronze and its value in outside society is not significant. The beginning of the festival with the burning of incense and also the lighting of lamps is called Sasatsua (burning of incense) and after that the actual festival begins.
|
ওয়ানগালা Wangala |
The first two days of the Wangala festival are known as 'Churugala' or abbreviated as 'Rugala' and 'Gakata' respectively. On the day of Rugala, dancing and drinking begin, but on that day people don't wear any new ornaments or tuck long rooster feathers into their turbans. That day in the afternoon pigs and cows were killed and their meat was distributed among the villagers. If the villagers are very poor, they buy a big pig or cow together by raising a subscription and slaughter it on Rugala day and share the meat.
Well-to-do families slaughter pigs or cows for themselves and keep some of the meat for themselves and distribute the rest to poor neighbors. Guests who come from the countryside to witness the Wangala festival are treated with great respect and care regardless of their social status. The first dance started at Akhin Nakma's house in Wangala ceremony. In the beginning, usually the girls perform the dance and the men stand in a row and play various musical instruments to the rhythm of the dance. At the beginning of the dance the Akhin Nakma spreads a quantity of rice inside and outside his house and also pours chu vichi (liquor).
The dancing troupe trampled the spread of rice and wine and began to dance. In this way, the dance continues day and night going from house to house in the village. Different stages of this Wangala festival are performed with different dance styles with different names and each of them is quite meaningful and equally important.
The dances are described below.
Grang Dakka (Blowing of Horns):
This dance is performed in accordance with the Wangala festival dance. Akhin Nakma, the centerpiece of the festival, starts this dance performance by chanting 'Ahawa' slowly with millay (sword) in one hand and spi (shield) in the other. At that time the musical instruments started playing softly. The main theme of this dance is to invite everyone to "Let's dance, let's sing".
_Dakru Su-a (Fighting of Pigeons):
This dance means "Innocent creatures like wild doves are always striving to protect their rights from harmful influences". In this dance, the girls face each other in two rows and attack each other in a slow dance to the rhythm of the music.
Purata Ratta (gathering of grains vertically):
This dance means "to strive to conserve life's precious resources while still having time." In this dance, the girls dance in a row to the rhythm of the music and show the gesture of collecting something from above.
Oping Ratta (Weed Uprooting):
During this dance, the girls march towards the boys who are fighting in a row opposite them and pretend to cut the turbans of the boys with their hands.
5. Ajema Rua (Pathway Dance) :
In this dance, the girls go ahead of the boys and walk in the rhythm of the musical instruments. Rue Ama (Dance of Young Women in Pravina Pravina Dress): In this dance, girls wear veils on their heads and dance in Pravina dress and boys play musical instruments in Pravina dress.
Dama Zajka (Change of Dama):
In this dance, the male musicians play very loudly
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content