টেলিগ্রামের প্রধান নির্বাহী ধনকুবের পাভেল দুরভ ফ্রান্সে গ্রেফতার



সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পাভেল দুরভকে গ্রেফতার করেছে ফরাসি পুলিশ।


শনিবার প্যারিসের উত্তরে অবস্থিত লা বুরজে বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।


রুশ বংশোদ্ভূত ৩৯ বছর বয়সী ধনকুবেরকে টেলিগ্রাম অ্যাপ সম্পর্কিত একটি অপরাধে জড়িত থাকার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে বলে বলে জানা যাচ্ছে।


ফরাসি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে যে, মি. দুরভকে বহনকারী ব্যক্তিগত উড়োজাহাজটি শনিবার সন্ধ্যায় ফ্রান্সের লা বুরজে বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উড়োজাহাজ থেকে নামার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা তাসের একটি খবরে বলা হয়েছে যে, মি. দুরভকে গ্রেফতারের খবরটি রুশ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই জানতে পেরেছে এবং পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।


গ্রেফতারের বিষয়ে ফ্রান্সে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাস ‘তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ’ নিচ্ছে বলেও রুশ সংবাদ মাধ্যমটির খবরে জানানো হয়েছে।


গ্রেফতারের বিষয়ে ফরাসি গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে যে, বার্তা আদান-প্রদানের জনপ্রিয় মাধ্যম টেলিগ্রামে অপরাধমূলক কার্যকাণ্ড নির্বিঘ্নে চলতে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।


এই অভিযোগেই মি. দুরভকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে খবরে বলা হচ্ছে।


তবে বিষয়টি নিয়ে টেলিগ্রাম অ্যাপ কিংবা ফরাসি পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

মেসেজিং অ্যাপ হিসেবে সারা বিশ্বেই টেলিগ্রামের বেশ জনপ্রিয় রয়েছে। ২০১৩ সালে অ্যাপটি চালু করার পর রাশিয়া, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে টেলিগ্রাম ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।


এরপর টেলিগ্রাম ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য নিতে রুশ সরকারের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ শুরু হলে ২০১৪ সালে রাশিয়া ছেড়ে দুবাই চল যান মি. দুরভ। এরপর সেখান থেকেই অ্যাপটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।


দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৮ সালে টেলিগ্রাম ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রুশ সরকার। যদিও সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বছর তিনেকের মাথায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।



প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই সারা বিশ্বে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রাম।


পরিসংখ্যান বলছে, ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও উইচ্যাটের পর এটিই পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।


২০২৫ সালের মধ্যে অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, টেলিগ্রাম প্রতিষ্ঠাতার মাধ্যমে মি. দুরভ বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

টেলিগ্রামের জনপ্রিয়তার কারণ কী?

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে টেলিগ্রাম অ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা পাভেল দুরভ জানান, আগামী এক বছরের মধ্যে অ্যাপটি সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যায় এক বিলিয়নের মাইলফলক ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা।


প্রতিষ্ঠার মাত্র এক যুগের মধ্যে অ্যাপটি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে কারণ কী?


বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপদে বার্তা আদান-প্রদানের পাশাপাশি একে অপরের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে যোগাযোগের সুযোগ থাকায় দ্রুত ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে টেলিগ্রাম অ্যাপের।


ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশ দু'টিতে টেলিগ্রাম অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে।



আর তাই বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মূলধারার প্রায় সব গণমাধ্যম, সরকারি সংস্থা ও আলোচিত ব্যক্তিরা টেলিগ্রামে চ্যানেল পরিচালনা করছেন।


ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও টেলিগ্রাম অ্যাপে নিয়মিত ভিডিও পোস্ট করেন।


সাক্ষাৎকারে পাভেল দুরভ বলেন, "টেলিগ্রাম অ্যাপ ব্যবহারকারীদের সহজে বার্তা, ফোনকল ও অন্যান্য ফাইল আদান-প্রদানে সহায়তা করে। আর তাই খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে অ্যাপটি।"


বর্তমানে অ্যাপটিতে ৯০ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছেন।


সামাজিক মাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাম নিরপেক্ষ থাকতে চায় বলেও জানিয়েছেন মি. দুরভ।


"আমরা কোনো ধরনের ভূরাজনীতির অংশ হতে আগ্রহী নই," বলেন অ্যাপটির প্রতিষ্ঠাতা।

জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির বিপরীতে সরকারি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ না থাকায় রাশিয়া ছাড়াও আরও যে দু-একটি দেশে টেলিগ্রাম নিষিদ্ধের ঘটনা অতীতে ঘটেছে, ইরান সেগুলোর একটি।


জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ঘোষণা করে ২০১৮ সালে দেশটির সরকার টেলিগ্রাম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।


তখন ইরানে অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় চার কোটি।


ব্যবহারকারীদের মতে, টেলিগ্রাম তাদের গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগ দেয়, যার ফলে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সেখানে নজরদারি করতে পারেনা।


আর সেকারণেই ইরানে অ্যাপটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এতে ভয় পেয়ে সরকার টেলিগ্রামের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বলেও অভিযোগ করেন ব্যবহারকারীরা।


নিষিদ্ধের কয়েক মাস আগে ইরানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।


তখন অন্তত আশিটি শহর জুড়ে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানেও যোগাযোগ, ছবি আর ভিডিও আদানপ্রদানে টেলিগ্রাম অ্যাপটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।


সামাজিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি ইরানের অনেক মানুষ প্লাটফর্মটিকে রুজিরোজগারের উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করতেন। তেমনই একজন আলী রেজা।


''আমি টেলিগ্রামের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ইচ্ছুকদের কাছে শিক্ষা ভিডিও ক্লিপগুলো বিক্রি করি। আমার রোজগার ভালোই, দরকারি সব খরচ হয়ে যায়। টেলিগ্রাম ব্লক হয়ে থাকায় আমি সংকটেই পড়েছি," নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিবিসিকে বলেছিলেন মি. রেজা।


এদিকে, চলতি বছর ইউরোপের দেশ স্পেনেও অ্যাপটি নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে।



কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে ইন্টারনেট সরবরাহকারীদের টেলিগ্রাম ব্যবহার স্থগিত করার নির্দেশ দেয় দেশটির আদালত।


এর আগে, ইরাক, ব্রাজিল এবং সোমালিয়াতে টেলিগ্রাম নিষিদ্ধ হয়েছিল।

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post