পর্যটনে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন , কক্সবাজার সৈকতে নারীদের হেনস্থার ভাইরাল ভিডিও


ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়, একদল উৎসাহী জনতা এক নারীকে কান ধরিয়ে ওঠ-বসা করাচ্ছে। আর তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাঠের তক্তা হাতে ফারুকুল ইসলাম।




ভিডিওর শুরুতে দেখা যায়, ফারুকুল ওই নারীর মুখের সামনে কাঠের তক্তা তুলে নানা ধরনের প্রশ্ন করছেন, তার বাড়ি কোথায়, বাড়ির নম্বর আছে কিনা।


এ সময় তিনি ধমকের স্বরে বার বার মেয়েটিকে তার মাস্ক খুলতে বলেন, “চিনস নাই আমারে? খুল এইটা!”


পরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক নারী মেয়েটির মুখ থেকে জোর করে মাস্ক টেনে খুলে ফেলেন।


এক পর্যায়ে লাঠির আঘাত থেকে রক্ষা পেতে ভুক্তভোগী ওই নারী কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য হন।


এ সময় ঘটনাস্থলে থাকা অনেকেই সৈকতের পাশে হয়রানির এই দৃশ্য মোবাইলে ধারন করছিলেন। শুধু তাই নয়, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তার কান ধরে ওঠ-বস গণনাও করছিলেন।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, এক দল যুবক সৈকতে পেতে রাখা বিচ চেয়ারে বসা এক নারীকে হয়রানি করছে। সেখানেও কাঠের তক্তা হাতে ফারুকুলকে দেখা যায়।


তারা অতর্কিতভাবে ওই নারীকে ঘিরে ধরে তাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে, “বাড়ি কোথায় আপনার, এখানে কী করেন, একা ঘুরতে এসেছেন কেন? রাত কয়টা বাজে?”


এক পর্যায়ে ওই নারীকে তারা পেটানোর ভয় দেখিয়ে চেয়ার থেকে উঠে যেতে বাধ্য করে।


ভিডিও ধারন করা ব্যক্তি বলে ওঠেন “এখন পর্যন্ত কেলানি (মারধোর) দিয়ে আসছি ওখান থেকে। সম্মানের সাথে উঠে চলে যান, নাহলে কিন্তু অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। কেলানি খাবেন? দেন দেন শুরু করে দেন।”


তৃতীয় ভিডিওতে দেখা গিয়েছে এক নারী কয়েকজন পুলিশ সদস্যের কাছে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হাতজোড় করে তার মোবাইল ফোনটি চাইছেন।


সেই নারীকেও বহু মানুষ ঘিরে ধরে ছিলেন। যার মধ্যে ফারুকুলকেও দেখা যায়।


ওই নারী বার বার তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কাকুতি মিনতি করে বলছিলেন, “আমার ফোনটা দিয়ে দেন। আমি আর কখনো আসবো না কক্সবাজারে। যদি দেখেন, আপনারা পানিশমেন্ট দিয়েন। আমি এখনই টিকেট করে চলে যাবো।”


অভিযুক্তের ফেসবুক পেইজ থেকে এসব ভিডিও এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট স্ট্যাটাস পোস্ট করতে দেখা যায়।


তার প্রোফাইল দেখে ধারণা করা হচ্ছে, ভিডিওগুলো ১১ই সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সি-গাল থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট এলাকায় ধারন করা হয়েছে।


এমন আরো ভিডিও থাকতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এই ভিডিওগুলো ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ফেসবুকে শুরু হয় নিন্দার ঝড়।

একদিকে অনেকে যেমন এই বিকৃত ও বেআইনি ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন অন্যদিকে অনেকে নারীদের সাথে এমন অসদাচরণের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।


এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ওসি জাবেদ মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ঘটনা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। কিন্তু কবে ঘটেছে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।


ভিডিওতে লাঠি হাতে যে যুবককে দেখা যাচ্ছে, তার নাম ফারুকুল ইসলাম। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকায় বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।


“এই ছেলের বয়স ২২ বছর, সে নিজেকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বলেছে। কক্সবাজার শহরে সে ব্যবসার সাথে জড়িত বলে জানতে পেরেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ডিবির ওসি জাবেদ মাহমুদ।


মি. মাহমুদ বলেন, অভিযুক্ত যুবককে শুক্রবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।


এই ধরনের হেনস্থার ঘটনা মানুষ যখন দেখবে তখন তারা পর্যটনের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

পর্যটনে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন , কক্সবাজার সৈকতে নারীদের হেনস্থার ভাইরাল ভিডিও

শনিবার পুলিশ সদর দপ্তরের একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসা নারীদের হেনস্তা ও মারধরসহ হয়রানির ঘটনায় জড়িত মোঃ ফারুকুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ।


''কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কয়েকজন যুবক কর্তৃক নারীকে প্রকাশ্যে হেনস্তা, অবমাননা শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি পুলিশের দৃষ্টিগোচর হয়। ভিডিও দেখে ঘটনায় অভিযুক্ত মোঃ ফারুকুল ইসলামকে সনাক্ত করা হয়,'' পুলিশের বার্তায় বলা হয়েছে।

সমুদ্র সৈকতে নারীকে হেনস্থা করার বিষয়টিকে উদ্বেগজনক হিসেবে বর্ণনা করছেন কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল মালিকরা। তারা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনায় পর্যটন শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।



“যেভাবেই হোক না কেন এটা পর্যটন শিল্পের জন্য শুভ সংকেত বলা যায় না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম শিকদার।


“ভিডিওতে আমি দেখলাম মেয়েটা কাঁদছে, পর্যটন সংস্কৃতির আলোকে এটা কাম্য নয়। মানুষ যখন পর্যটনের উদ্দেশ্যে আসে তখন তারা রিল্যাক্সে থাকতে পছন্দ করে। সেটাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো একেবারেই কাম্য নয়,” বলছিলেন মি. শিকদার।


হোটেল মালিকরা বলছেন, পর্যটন শিল্প বিকাশের মূল শর্ত হচ্ছে মানুষের নিরাপত্তা। মানুষ যদি নিরাপদ বোধ না করে তাহলে তারা পর্যটক হিসেবে আসবে না। সমুদ্র সৈকতে নারীকে হেনস্থার ঘটনা তাদের বিচলিত করেছে।


“এ ধরনের ঘটনা আমরা কক্সবাজারে আগে কখনো দেখিনি। পর্যটকদের জন্য শতভাগ নিরাপদ পরিবেশ থাকতে হবে,” বলছেন মি. শিকদার।


গত দুই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কক্সবাজারে পর্যটন শিল্প মন্দা যাচ্ছে বলে মালিকরা বলছেন। এরমধ্যে নারী হেনস্থা করার ঘটনা পর্যটকদের মনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে বলে হোটেল-মোটেল মালিকরা মনে করছেন।


এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কক্সবাজারে ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা নিজেদের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।


কৌশিক মিত্র দীপ নামে এক ইউজার তার ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের কোথায় আছে যে একটা নারী রাতের বেলা কোথাও বসে থাকতে পারবে না, তাও পাবলিক প্লেসে, সমুদ্র সৈকতের মতো জায়গায়? কোন আইনে আছে যে একটা নারী কোথাও একা নিজের মতো সময় কাটাতে চাইলে বা বসলে তাকে হেনস্থা করা হবে, পেটানো হবে?”


এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ফারহানা মেহজাবিন তার ফেসবুক পোস্টে জানান, ‘ভিডিওগুলো দেখবেন, মেয়েগুলোকে যেভাবে হেনস্থা করা হয়েছে, আপনি যদি কোনদিন নিজের জীবনে কোন ইয়াবা বা ফেন্সিডিল ব্যবসায়ীকে কক্সবাজারে এভাবে হেনস্থা করা হয়েছে সেটার প্রমাণ দিতে পারেন, আমি উপকৃত হবো। কারণ আমি অন্তত দেখিনি।’


বেশিরভাগই এ ঘটনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন। নেটিজেনদের অনেকে আবার এই ঘটনার পেছনে ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন।


তবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে বলেছে যে এ ঘটনায় তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই।

নেটিজেনদের আরেকটি অংশ নারীদের ওপর এই হয়রানিমূলক ঘটনাকে বেশ স্বাগত জানিয়েছে এবং এ ধরনের অভিযান চলমান রাখা উচিত বলে মত দিয়েছেন।

পর্যটনে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন , কক্সবাজার সৈকতে নারীদের হেনস্থার ভাইরাল ভিডিও


এর আগে গত অগাস্ট মাসে ঢাকার শ্যামলী এলাকার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে লাঠি হাতে এক যুবককে রাস্তায় নারীদের পেটাতে দেখা যায়।


বাংলাদেশের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ওই যুবকসহ কয়েকজন বেশ কয়েকদিন ধরে ভাসমান যৌনকর্মীদের এভাবে লাঠি দিয়ে মারধর করেছেন।


ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা কল্যাণময়ী নারী সংঘ নামে একটি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, গত অগাস্ট মাসে ২৭ তারিখ থেকে এভাবে অন্তত ৬০ জন যৌনকর্মী হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছেন।


এসব ঘটনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।


মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ''শুধু পর্যটন এলাকা নয়, দেশের যেকোনো স্থানে একজন নারীকে এ ধরনের হেনস্থা, হয়রানি করা অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। এখানে দুষ্কৃতিকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্কৃয়তার সুযোগ নিয়েছে"।


"এক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা হওয়া উচিত। এ ধরনের অপরাধ দমনে সরকারের আরো তৎপর হওয়া দরকার,'' তিনি বলেন।



Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post