সাগর উপকূলে ওয়েস্টার চাষ
বাংলাদেশের ৪৮০ কিমি. দীর্ঘ তটরেখা এবং ১০ লক্ষ হেক্টরের কাছাকাছি বিস্তীর্ণ জলসীমা জুড়ে বিদ্যমান রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক ঝিনুক (Bivalve) সম্পদের সমাহার। সাধারণত বিভিন্ন প্রকারের ঝিনুককে মলাস্ক (MollusC) নামে অভিহিত করা হয়। অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন একটি ঝিনুক প্রজাতি হচ্ছে। ওয়েস্টার। ওয়েস্টারকে গুগলি ও শুক্তি নামে অভিহিত করা হয় এবং স্থানীয়ভাবে উপকূলে এটিকে কস্তুরা’ বা ‘কস্তুরী’ বলা হয় । প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রজাতির ওয়েস্টার সরাসরি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অর্থনৈতিকভাবে ওয়েস্টারের গুরুত্ব অপরিসীম যেটির বিজ্ঞানসম্মত ও প্রযুক্তি ভিত্তিক চাষের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। প্রাকৃতিকভাবে এই মূল্যবান ওয়েস্টার সম্পদের যথাযথ উন্নয়ন করা সম্ভব হলে অদূর ভবিষ্যতে এটি দেশের একটি অন্যতম আয় সৃষ্টিকারী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে ।
ওয়েস্টার ও ঝিনুক ছাঁকুনি খাদক (Filter feeder) ও উপবিষ্টকারী (Sedentary) । জীব যা প্রস্তর শিলা, কাঠ ও কনক্রিটের গঠন, নুড়ি, ইট, খােসা, গাছের গুড়িসহ যে কোন শক্ত বস্তুর উপর জোয়ার-ভাটা সংলগ্ন অঞ্চলে জন্মায়। অধিকাংশ ওয়েস্টার প্রজাতি স্বল্প লবণাক্ততা (১৭-৩৫ পিপিটি) সহিষ্ণু বিধায় লােনাপানি, মােহনা অঞ্চল এবং জলাভূমিতে এদেরকে পাওয়া যায় । বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, কক্সবাজার, টেকনাফ ও উপকূলবর্তী মােহনা অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির ওয়েস্টারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় । সেন্টমার্টিন দ্বীপের সমগ্র প্রবাল শিলা জুড়ে প্রচুর পরিমাণে ওয়েস্টার পাওয়া যায়।
ওয়েস্টার ঝিনুকের গুরুত্ব খাদ্য হিসেবে :
যদিও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার অধিকাংশ ধর্মীয় কারণে। ওয়েস্টার, ঝিনুক ভক্ষণে অভ্যস্ত নয় কিন্তু চট্টগ্রামের উপজাতি গােষ্ঠী ও উপকূলবর্তী। রাখাইন সম্প্রদায়, অধিকাংশ সংখ্যালঘু পৌত্তলিক সম্প্রদায় এবং উপজাতি সম্প্রদায়ের মাঝে ওয়েস্টারের মাংসল অংশ সুস্বাদু খাবার হিসেবে বিবেচিত। ওয়েস্টার ঝিনুক অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য যাতে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, খনিজ ও ভিটামিন রয়েছে। এ ছাড়াও ওয়েস্টারে উচ্চমাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে যেগুলাে নিশ্চিতভাবে হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক এবং নিম্ন রক্ত চাপের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। আমেরিকান ও ইতালির গবেষকরা ওয়েস্টারের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইনাে এসিডের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ওয়েস্টার খেলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালাে ও সহায়ক কোলেস্টরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ক্ষতিকর কোলেস্টরলের মাত্রা কমে যায় । পথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জর্ডান, কুয়েত, সৌদিআরব, বাহরাইন এবং ইউরােপীয় ইউনিয়নভূক্ত সকল দেশে ওয়েস্টার একটি অন্যতম সামুদ্রিক খাদ্য (Seafood) হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় । আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স এবং অস্ট্রেলিয়াতে ওয়েস্টার অতি জনপ্রিয় হওয়ায় এই দেশগুলােতে বিভিন্ন। ধরনের বাণিজ্যিক ওয়েস্টার বার গড়ে উঠেছে।
শিল্প কারখানায় :
ওয়েস্টারের শক্ত খােলস হতে চুন তৈরি করা হয়, এবং ক্যালসিয়াম-অক্সাইড নিষ্কাশন করা হয় যা ঢালাই লৌহ শিল্পে লােহার প্রক্ষেপন ও সংকোচনে ব্যবহার করা হয়। আধুনিক ও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত লবণকে দৃঢ়তা। প্রদানের কাজেও ক্যালসিয়াম-অক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া চিনি ও কাগজ শিল্পে এবং ওষুধ শিল্পেও ওয়েস্টারের উপকরণসমূহ বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । সেভেন সিস্টার্স
অলঙ্কার উৎপাদনে : ওয়েস্টার-ঝিনুক থেকে সাদা উজ্জ্বল বর্ণের মুক্তা পাওয়া যেটি বাণিজ্যিকভাবে অনেক মূল্যবান । মিঠাপানির ঝিনুক চাষ করে মুক্তা ও ইমেজ মুক্তা | উৎপাদনে ইতােমধ্যেই বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সফলতা লাভ করেছে। একইভাবে আমাদের সামুদ্রিক জলসীমায় মুক্তা উৎপাদনকারী ওয়েস্টার। প্রজাতি বিদ্যমান থাকায় আমাদের মুক্তা চাষ শিল্প আরাে সমৃদ্ধ করার সুযােগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ওয়েস্টারের শক্ত খােলস থেকে হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরণের। আকর্ষনীয় নকশার অলঙ্কার তৈরি হয়ে থাকে যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ করে উপকূলীয় শহর কক্সবাজার, পতেঙ্গা, মহেশখালী, এবং টেকনাফের বিভিন্ন। ( বিপনীতে বিক্রয় করা হয়।
পরিবেশের সহায়ক উপাদান হিসেবে : ওয়েস্টার মাটি ও পানি থেকে এ্যালকালির মাত্রাকে কমিয়ে দিয়ে জলজ পরিবেশকে মারাত্মক দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে ।। পৃথিবীব্যাপি চাষকৃত ওয়েস্টার বাৎসরিক সমুদ্রের পানি থেকে ১২৩০ টনেরও অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড শােষণ করে নিয়ে গ্রীনহাউস এর প্রভাবকে প্রশমিত করে। এছাড়াও ওয়েস্টার পানির প্ল্যাঙ্কটন বুমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পানিতে ভাসমান তৈলাক্ত উপাদানকে বিশােধন করে জলজ প্রাণিদের মৃত্যুর হুমকি থেকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ওয়েস্টার চাষের জন্য সৃষ্ট কৃত্রিম ডুবােচর (Artificial reef) কমপক্ষে ৩৪ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ১৬ প্রজাতির চিংড়ির নিরাপদ আবাসস্থলের নিশ্চয়তা দেয় । ওয়েস্টার চাষের বেড (Oyster bed) তৈরির জন্য সৃষ্ট কৃত্রিম ডুবােচর প্রাকৃতিকভাবে সরাসরি উপকূলীয়। বাধকে জোয়ার এবং ঢেউয়ের কারণে সৃষ্ট ক্ষয় ও ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা করে ।
বিশ্বব্যাপি মুক্তা উৎপাদনকারী ওয়েস্টার ঝিনুকের চাষ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলােতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী হিসেবে ওয়েস্টার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। বাংলাদেশের জলবায়ু, মাটির রাসায়নিক গঠন, বিদ্যমান জলীয় ও তাপমাত্রার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ওয়েস্টার চাষের জন্য খুবই অনুকূল । আমাদের উপকূলজুড়ে প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমাণে ওয়েস্টার লার্ভিস্প্যাট এর উপস্থিতি।
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content