মিঠাপানির ঝিনুকে মুক্তা চাষ
মুক্তা একটি দামী রত্ন যা সৌখিনতা ও আভিজাত্যের প্রতীক। এটি এমন একটি রত্ন যা জীবিত জীবের দেহের ভিতর জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। মুক্তা অলংকারে। শােভিত আকর্ষণীয়, কাঙ্খিত মূল্যবান একটি রত্ন । মুক্তার প্রধান ব্যবহার অলংকার। হলেও কিছু কিছু জটিল রােগের চিকিৎসায় মুক্তা ও মুক্তাচূর্ণ ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত। হয় । পূর্বে মুক্তা প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হত । ১৮৯০ সালে জাপানী বিজ্ঞানী কোকিচী। মিকিমােতাে সর্বপ্রথম প্রণােদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদনে সফল হন । এজন্য তাকে জাপানী মুক্তা শিল্পের জনক বলা হয়। বর্তমানে চীন, জাপান ও ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ প্রণােদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদন করে । আন্তর্জাতিক বাজারে যেমন মুক্তার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে তেমনি আভ্যন্তরিণ বাজারেও মুক্তার চাহিদা দিন দিন। বৃদ্ধি পাচ্ছে । যখন গবেষণাগারে মুক্তা উৎপাদন শুরুই হয়নি, কেবলমাত্র প্রাকৃতিক উৎস থেকেই মুক্তা সংগ্রহ করা হত তখন বিশ্বব্যাপি আমাদের এই উপমহাদেশে প্রাপ্ত মুক্তার ব্যাপক চাহিদা ছিল। আমাদের দেশের মাটি ও পানির ভৌত । রাসায়নিক গুণাগুণ মুক্তা চাষের অনুকূল । এছাড়া এদেশের জলবায়ুও মুক্তা চাষ। উপযােগী । বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৯৯ সালে মিঠাপানিতে মুক্তা চাষের পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু করে
ইনস্টিটিউট কর্তৃক মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক চিহ্নিতকরণের উদ্দেশ্যে দেশব্যাপি পরিচালিত জরিপে বাংলাদেশে ৪ ধরণের মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক পাওয়া যায় : (১) Lamellidens marginalis (২) Lamellidens corrianus (0) Lamellidens phenchooganjensis (8) Lamellidens jenkinsianus 1 45 75 Lamellidens marginalis 3 Lamellidens Corrianus এই ২ ধরণের ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদন হার বেশী । ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ঝিনুকে প্রণােদিত পদ্ধতিতে মুক্তা উৎপাদনের কৌশল। উদ্ভাবন করেছেন । মুক্তা উৎপাদনকারী অপারেশনকৃত ঝিনুকের বেঁচে থাকার হার প্রাথমিক অবস্থায় ৬০% এবং তাতে মুক্তা তৈরির হার ৯০% । • একটি ঝিনুক থেকে সর্বোচ্চ ১২টি মুক্তা উৎপাদিত হয়েছে। অপারেশনকৃত ঝিনুকের বিভিন্ন ধরণের চাষ পদ্ধতির ওপর গবেষণা করে আমাদের দেশের উপযােগী চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে । • ঝিনুকে চার রংয়ের (কমলা, গােলাপী, সাদা, ছাই) এবং তিনটি অকাতের
(গােল, রাইস, আঁকাবাকা) মুক্তা পাওয়া গেছে। • ইমেজ মুক্তা তৈরিতে সফলতা অর্জিত হয়েছে
মুক্তার প্রকারভেদ :
মুক্তা প্রধানত দুই প্রকার। ক) প্রাকৃতিক মুক্তা : প্রকৃতিতে কোন বহিরাগত বস্তু দৈবাৎ ঝিনুকের দেহের নরম অংশে প্রবেশ করে যদি আঘাতের সৃষ্টি করে তবে ঝিনুক সেই আঘাতের যন্ত্রণা। থেকে উপশম পেতে বহিরাগত বস্তুটির চারদিকে এক ধরণের লালা নিঃসরণ। করতে থাকে। ক্রমাগত নিঃসৃত এই লালা বস্তুটির চারদিকে ক্রমান্বয়ে জমাট বেঁধে প্রাকৃতিক মুক্তায় পরিণত হয়। খ) প্রণােদিত উপায়ে উৎপাদিত মুক্তা : একটি ঝিনুকের ম্যান্টল টুকরা (পর্দার টকরা) আর একটি জীবিত ঝিনুকে সরাসরি প্রতিস্থাপিত করা হয় যা থেকে । লালা নিঃসরণের মাধ্যমে মুক্তা তৈরি হয়। এটি দৈবাৎ কোন ঘটনা নয় সম্পূর্ণ । ইচ্ছাকৃত । প্রণােদিত উপায়ে মুক্তা তৈরির ক্ষেত্রে অপারেশনকৃত সব কয়টি । ঝিনুকই মুক্তা তৈরির জন্য প্রস্তুত থাকে। প্রণােদিত উপায়ে মুক্তা তৈরির। কৌশলটিকে অপারেশন বলা হয়ে থাকে। এই অপারেশন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে প্রণােদিত উপায়ে উৎপাদিত মুক্তাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়
আন্টল টিস্যুর মুক্তা : জীবিত ঝিনুকের দেহে ম্যান্টল টুকরা প্রবেশ করানাে। হয়। এই টুকরাটিই লালা ফেলে ধীরে ধীরে মুক্তা তৈরি করে। যেহেতু একটি পাতলা পর্দা থেকে মুক্তা তৈরি হয় তাই এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মুক্তা হতে কমপক্ষে ৩ বছর সময় প্রয়ােজন হয়।।
অপারেশনের পূর্ববর্তী পরিচর্যা।
০ অপারেশনের পূর্বে ঝিনুক সংগ্রহ করে পুকুরে ১-৩ মাস প্রতিপালন করে।
অপারেশনের উপযােগী করে তুলতে হবে ।
০ অপারেশনের ৭ দিন পূর্বে পুকুর থেকে ঝিনুক সিস্টার্নে এনে না খাইয়ে রেখে।
অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
অপারেশনের ২ ঘন্টা আগে প্রতিস্থাপনের ঝিনুককে নিচের দিকে মুখ করে ঠান্ডা জায়গায় ট্রেতে রাখতে হবে ।।
অপারেশন পদ্ধতি :
অপারেশনটি দুটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়, টিস্যু টুকরাে করা ও টিস্যু প্রতিস্থাপন । অপারেশনের ধাপ দুটি একই সাথে সম্পন্ন করতে হবে । ঝিনুক বাছাইকরণ : অপারেশনের জন্য ১-২ বছরের বয়সী স্বাস্থ্যবান ঝিনুক যার। বৃদ্ধি রেখা স্পষ্ট এবং শক্তিশালী পা আছে সেটি বাছাই করতে হবে । ঝিনুক রােগ ও ক্ষতমুক্ত হতে হবে । ম্যান্টল টিস্যু টুকরাকরণ। • অপারেশনের আগে ঝিনুকগুলাের মুখ নিচের দিক করে ট্রেতে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় যেন ভিতরে পানি জমে না থাকে • ঝিনুকের দু’টি ভালভ বা খােল পুরােপুরি খােলা হয় । ঝিনুক কাঁচি/চাকুর সাহায্যে কেটে ট্রের উপরে রাখা হয়। ও ঝিনুকের পশ্চাৎ অংশের ম্যান্টল টিস্যুর প্যালিয়াল লাইন বরাবর কাচির সাহায্যে লম্বালম্বিভাবে কাটা হয়। • এরপর চিমটার সাহায্যে টিস্যুটি উল্টো করে তুলে কাঠের বাের্ডের উপর রেখে বাড়তি অংশগুলাে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলা হয়।
ও ধারালাে ছুরি দিয়ে ২-৩ মিমি. বর্গাকৃতির ছােট ছােট টুকরা করা হয়। • ছােট টুকরােগুলাের উপর এজুমিন দেওয়া হয় । টিস্যু টুকরাে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পর্যন্ত ব্যবহার উপযােগী থাকে।
টিস্যু প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া
অপারেশনের আগে ঝিনুকগুলাের মুখ নিচের দিক করে ট্রেতে সারিবদ্ধভাবে । রাখা হয় যেন ভিতরের পানি জমে না থাকে। • প্রথমত স্প্যাচুলার সাহায্যে ঝিনুকের মুখ ৮-১০ মিমি. খুলে স্ট্রপল দিয়ে আটকিয়ে ঝিনুকটি একটি কাঠের ফ্রেমে স্থাপন করা হয়। এসপিরেটরের। সাহায্যে ঝিনুকের গায়ে লেগে থাকা কাদা ও লালা পরিস্কার করা হয়। স্কালপেলের সাহায্যে ম্যান্টল টিস্যুটি কেটে ভােতা মাথার বিশেষ ধরণের সূচ দিয়ে দুই পর্দার মাঝখানে এমনভাবে থলে বা পকেট তৈরী করা হয় যেন পর্দাটি। উপরে বা নিচে ছিড়ে না যায়। এরপর বাঁকা নিড়লের সাহায্যে টিস্যুটিকে ফাঁকা করে অপর একটি নিড়ল এর । সাহায্যে পকেটে টিস্যু টুকরা প্রবেশ করানাে হয়। • এরপর খুব সাবধানে কাটা অংশটি বন্ধ করে দেওয়া হয় ।
২) নিউক্লিয়াস মুক্তা : নিউক্লিয়াস মুক্তা তৈরিতে একটি নিউক্লিয়াস এক টুকরা
ম্যান্টলসহ জীবিত ঝিনুকের দেহে অপারেশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানাে হয়। ম্যান্টল টুকরাটি নিউক্লিয়াসের গায়ে লেগে থাকে । নিউক্লিয়াস মুক্তা উৎপাদনে । কম সময় লাগে এবং সহজেই গােলাকৃতি মুক্তা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন । এক থেকে দেড় বছরে নিউক্লিয়াস মুক্তা সংগ্রহ করা সম্ভব।
অপারেশনের পূর্ববর্তী পরিচর্যা। • কালাে ছিদ্রযুক্ত বাক্সে (৪০ সেমি. x ৩০ সেমি. x ১০ সেমি.) ঝিনুক রেখে পুকুরের পানির উপরের স্তরে ১০ দিন রাখা হয়। • এরপর ১.৫ মি. গভীর পানিতে আরও ১০ দিন রাখা হয়। • এরপর বাক্সটি উপরে তলে ৩-৪ ঘন্টা রােদের আলােতে শুকিয়ে আবার ২ সেমি. গভীর পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় । • আবারাে ১.৫ মি. গভীরে ডুবিয়ে ৩ দিন রেখে পরবর্তীতে সেই ঝিনুকগুলােকে অপারেশন রুমে নিয়ে এসে দুই ঘন্টা রেখে দেওয়া হয় । ঝিনুক বাছাইকরণ : টিস্যুর জন্য ১-১.৫ বছর বয়সের ঝিনুক এবং টিস্যু ও নিউক্লিয়াস প্রবেশ করানাের জন্য ২-৩ বছরের সুস্থ সবল, রােগমুক্ত ও তরুণ ঝিনুক বাছাই করা হয়। ম্যান্টল টিস্যু কাটার প্রক্রিয়া। ০ অপারেশনের আগে ঝিনুকগুলাের মুখ নিচের দিক করে ট্রেতে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় যেন ভিতরের পানি জমে না থাকে। • ঝিনুকের দু’টি ভালভ বা খােল পুরােপুরি খুলে ঝিনুকের পশ্চাৎ অংশের ম্যান্টল টিস্যুর প্যালিয়াল লাইন বরাবর কাচির সাহায্যে লম্বালম্বিভাবে কাটা হয়। | এরপর চিমটার সাহায্যে টিস্যুটি তুলে নরম রুমালের উপর রেখে অপর একটি রুমালের সাহায্যে চেপে অতিরিক্ত পানি শুষে নেয়া হয় । এরপর রুমাল থেকে চিমটার সাহায্যে কাঠের বাের্ডে টিস্যুটি উল্টো করে রাখা।
হয় । বাড়তি অংশগুলাে কেটে ফেলে দেওয়া হয়। ০ ব্যবচ্ছেদ ছুরি দিয়ে ২-৩ মিমি. বর্গাকৃতির ছােট ছােট টুকরাে করা হয়। • ছােট টুকরােগুলাের উপর এজুমিন দেওয়া হয় । টিস্যু টুকরাে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পর্যন্ত ব্যবহার উপযােগী থাকে ।।
টিস্যু ও নিউক্লি প্রতিস্থাপন পদ্ধতি
• ঝিনুকের দুটি ভালভ বা খােল আংশিক উন্মুক্ত করে অপারেশন স্ট্যান্ড এ রাখাহয়।
০ স্কালপেলের সাহায্যে ম্যান্টল টিস্যটি কেটে ভােতা মাথার বিশেষ ধরণের সূচ। দিয়ে দুই পর্দার মাঝখানে এমনভাবে থলে বা পকেট তৈরী করা হয় যেন পর্দাটি
উপরে বা নিচের অংশে ছিড়ে না যায় । • কাটা অংশের দৈর্ঘ্য হতে হবে ৪ মিমি. এবং পকেটের দৈর্ঘ্য ২ সেমি. • এরপর বাকা নিড়লের সাহায্যে টিস্যুটিকে ফাঁক করে অপর একটি নিড়ল এর
সাহায্যে প্রথমে পকেটে টিস্যু প্রবেশ করানাে হয় । • এরপর কাপ হুক এর সাহায্যে নিউক্লিটি ঐ পকেটেই এমনভাবে প্রবেশ করানাে।
হয় যেন নিউক্লিটি টিস্যুর মাঝখানে বসে থাকে। • এরপর খুব সাবধানে কাটা অংশটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। • একই প্রক্রিয়ায় ঝিনুকটির অপর অংশে টিস্যু এবং নিউক্লি প্রবেশ করানাে হয়। • এভাবে প্রতিটি ঝিনুকে মােট ৪টি করে টিস্যুসহ নিউক্লি প্রবেশ করানাে হয়।।
চিত্র ২. ঝিনুকে ম্যান্টল টিস্যু টুকরা ও নিউক্লি প্রতিস্থাপন। ৩) ইমেজ মুক্তা : ইমেজ মুক্তা হচ্ছে কোন ইমেজ বা ছবিকে মুক্তায় পরিণত করা। মােম, খােলস, কাঠ, প্লাস্টিক ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান দিয়ে নানা রকম ইমেজ । তৈরি করে তাকে একটি জীবিত ঝিনুকের দেহে প্রবেশ করানাে হয় ।
ইমেজ তৈরি : প্রথমে একটি পরিস্কার মৃত ঝিনুকের টিস্যুবিহীন খােলসের ভিতরের অংশে সয়াবিন/সরিষার তৈল দিয়ে পিচ্ছিল করা হয়। এরপর গলানাে মােম উক্ত খােলসে ঢালা হয় এবং মােম জমাট বাধার পূর্বে খােলসটি ডানে-বামে নেড়ে মােমের একটি পাতলা স্তর (প্রায় ১.৫ মিমি.) তৈরি করা হয়। এরপর একটি সূচের সাহায্যে মােমের স্তরের উপর মৃদু চাপ প্রয়ােগ করে পছন্দ মাফিক ইমেজ তৈরি করা। হয় এবং তৈরিকৃত ইমেজটি এক মিনিট পরিস্কার পানিতে ডুবিয়ে মােমের খসখসে। ভাব দূর করা হয়। ঝিনুকে ইমেজ স্থাপন : নির্বাচিত ঝিনুকে সতর্কতার সাথে ম্যান্টল টিস্যুর নিম্নাংশে খােলস সংলগ্ন স্থানে ইমেজ স্থাপন করতে হবে । ঝিনুকের মুখ স্ট্রপলের সাহায্যে ধীরে ধীরে ৮-১০ মিমি. খুলতে হবে। এরপর ঝিনুকের অভ্যন্তরিণ অংশ এসপিরেটরের সাহায্যে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে । ঝিনুকের খােলসের গায়ে লেগে থাকা পর্দা (ম্যান্টল) সতর্কতার সাথে ইমেজের আকৃতি অনুযায়ী খুলতে হবে। এরপর পর্দা ও ঝিনুকের খােলসের মাঝখানে ইমেজ স্থাপন করতে হবে এবং স্পেচুলার সাহায্যে মৃদু চাপ দিয়ে অভ্যন্তরিণ বাতাস বের করতে হবে । তারপর স্ট্রপল খুলে ঝিনুকটিকে উর্ধ্বমুখী করে রাখতে হবে। সবশেষে ঝিনুকের খােলসে চিহ্নিতকরণ মার্ক/ট্যাগ দিয়ে জলাশয়ে চাষ করতে হবে।
অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যা : অপারেশনের পূর্বে ঝিনুককে না খাইয়ে রাখা হয়। বিধায় অপারেশনের পরে ঝিনুকগুলাে অনেক দূর্বল হয়ে পরে। এই জন্যে। অপারেশনের পরবর্তীতে ঝিনুককে ভালােভাবে পরিচর্যা করা প্রয়ােজন।
প্রথম ধাপ : নাইলনের দড়ি দিয়ে তৈরি নেট ব্যাগে ঝিনুক রেখে ব্যাগের মুখ সেলাই। করে দড়ির সাহায্যে সিস্টার্নে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এই অবস্থাতে এয়ারেটর এর সাহায্যে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে প্রথম ৭ দিন না খাইয়ে রাখতে হবে এবং প্রতিদিন পানি পরিবর্তন করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপ : প্রথম ৭-১০ দিন পর ঝিনুককে খাবার দেওয়া হয়। প্রতি ১,৫০০টি ঝিনুকের জন্য ২০০ লিটার করে প্রাংকটন দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে পানি পরিবর্তন করে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি মােট ১০ দিন। করতে হবে ।
তৃতীয় ধাপ : দ্বিতীয় ধাপ সম্পন্ন হলে ০.৯% লবণ পানিতে ঝিনুকটিকে ১০ মিনিট রাখা হয় যেন কোন ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু না থাকে। পরবর্তীতে ঝিনুকটিকে খাঁচায় করে পুকুরে রাখা হয়। খাঁচাটি পুকুরের তলদেশে এমনভাবে রাখা হয় যেন ঝিনুকগুলাের ক্ষত নিরাময় হয়। প্রতিদিন পানির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে ।
পুকুরে অপারেশনকৃত ঝিনুক চাষ পদ্ধতি। পুকুর প্রস্তুতি : মুক্তা চাষের পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যালাে থাকা অপরিহার্য। সূর্যালােকের উপস্থিতিতে মুক্তার রং ভাল হয় এবং ঝিনুকের জন্য পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় । মুক্তা চাষের জন্য ১.০-১.৫ মিটার পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পুকুর নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয় । নির্বাচিত পুকুরের পানি সরিয়ে তলদেশ ভালভাবে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এরপর শতকে এক কেজি হারে কলি চুন ভালভাবে প্রয়ােগ করতে হবে । পুকুর শুকানাের ২-৩ দিন পর পুকুরে পানি দিতে হবে । পুকুরে ঝিনুকের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১২৫ গ্রাম টিএসপি এবং ৫ কেজি জৈব সার পানিতে ছিটিয়ে প্রয়ােগ করতে হবে ।
পানির তাপমাত্রা ঝিনুকের খাদ্য গ্রহণ, বৃদ্ধি এবং নেকার নিঃসরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । পানির তাপমাত্রার ওপর ঝিনুকের অপারেশন কার্যক্রম সফলতা নির্ভর করে। পানির তাপমাত্রা যখন ২৬৩০° সে. এর ভেতরে থাকে তখন ঝিনুকের বিপাক ভাল হয়। অপারেশনের ক্ষত দ্রুত শুকায়, ম্যান্টল কোষের বেঁচে থাকার হার উচ্চ মাত্রায় থাকে, দ্রুত পার্ল স্যাক তৈরি হয়, নেকার নিঃসরণ দ্রুত থাকে। এসবই ভাল মুক্তা তৈরির উপযুক্ত শর্ত। পানির তাপমাত্রা ৩০° সে.এর উপরে হলে অপারেশনের ক্ষত দ্রুত শুকায় এবং পার্ল। স্যাক দ্রুত তৈরি হলেও ম্যান্টল টিস্যুর বেঁচে থাকার হার কমে যায়। খুব সহজে অপারেশনের ক্ষতে রােগ সংক্রমণ ঘটে ফলে অপারেশনকৃত ঝিনুকের মৃত্যুহার বৃদ্ধি। পায় । পানির তাপমাত্রা ১৫° সে. এর নীচে হলে অপারেশন ক্ষত সহজে শুকায় না, ম্যান্টল কোষের দ্রুত মৃত্যু ঘটে। মুক্তা তৈরির সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায় । মুক্তা চাষে। পানির অনুকূল তাপমাত্রা হলাে ২৬-৩০° সে.। পানির অনুকূল তাপমাত্রায় ঝিনুক দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং নেকার দ্রুত নিঃসৃত হয়ে মুক্তা গঠিত হয় । অম্লীয় (পিএইচ ৬.৫ এর চেয়ে কম) অথবা ক্ষারীয় (পিএইচ ৮.৫ এর চেয়ে বেশি) পিএইচ। ঝিনুকের বৃদ্ধি এবং মুক্তা উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত নয় । ঝিনুকের বৃদ্ধির জন্য পানির অনুকূল পিএইচ বা ক্ষারত্ব ৭-৮। পুকুরের পানির পিএইচ কমে গেলে শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়ােগ করতে হবে।
পানির প্রবাহ : পুকুরের পানিতে সামান্য প্রবাহ সৃষ্টি করা গেলে ঝিনুকের বৃদ্ধি সাধনে এবং মুক্তা উৎপাদনে সহায়ক হয়। তাই সম্ভব হলে প্যাডল হুইল ব্যবহার করে সামান্য প্রবাহের ব্যবস্থা করা যায়। মাসে একবার পুকুরের কিছু পরিমাণ পানি। পরিবর্তন করলে ভাল হয়।
প্রাকৃতিক খাদ্য : ঝিনুকের খাদ্য গ্রহণ মূলত পরােক্ষ । ফুলকার মাধ্যমে এরা। পানিতে বিদ্যমান এলজি, ক্ষুদ্রাকার জুওপ্লাংকটন, অণুজীব অর্থাৎ ফাইটোপ্লাংকটন ইত্যাদি জৈব দ্রব্য ঘেঁকে খায়। ডায়াটম, গােল্ড এলজি, গ্রীণ এলজি, ইউগ্লেনা ইত্যাদি ঝিনুকের উপযােগী প্রাকৃতিক খাদ্য। তাই পুকুরে যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য বিদ্যমান রাখার জন্য নিয়মমাফিক সার প্রয়ােগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ঝিনুক চাষের জন্য পানির উপযুক্ত রং হলাে হলুদাভ সবুজ এবং স্বচ্ছতা ৩০ সেমি. । নিম্ন বর্ণিত হারে পুকুরে সার প্রয়ােগ করতে হবে :
সারের নাম |
প্রয়োগ হার |
প্রয়োগ পদ্ধতি
|
প্রয়োগের সময় |
ইউরিয়া
|
১০০ গ্রাম / শতাংশ প্রতি ১৫ দিন অন্তর |
সরাসরি পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। |
সকালে সূ্যের আলোতে |
টি
এস পি |
সকালে ১২৫ গ্রাম / শতাংশ প্রতি ১৫ দিন অন্তর |
প্রইয়োগের পূর্বে ৩ গুণ পরিমাণ পানিতে
ভালভাবে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে |
|
জৈব সার |
৫ কেজি / শতাংশ; প্রতি ১৫ দিন অন্তর । |
সরাসরি পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে |
ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে সাপ্তাহিক অথবা পাক্ষিকভাবেও সার প্রয়ােগ করা যায় । সূর্যালােকিত দিনে সকাল ১০ টার মধ্যে গুলানাে সার পুকুরের চারদিকে সমানভাবে | ছিটিয়ে দিতে হবে। বৃষ্টির সময় বা মেঘলা দিনে এবং শীতকালে পানির তাপমাত্রা খুব কমে গেলে সার প্রয়ােগ করা উচিত নয়।
ক্যালসিয়াম : ক্যালসিয়াম মুক্তা উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। ঝিনুকের খােলস এবং মুক্তার প্রধান উপাদান হলাে ক্যালসিয়াম। পানিতে ক্যালসিয়াম যেন প্রতি লিটারে ১০ মিলিগ্রাম এর চেয়ে বেশি থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এজন্য পুকুরে প্রতি শতাংশে ২০০-২৫০ গ্রাম জিওলাইট প্রয়ােগ।
অন্যান্য পুষ্টি পদার্থ : ঝিনুক এবং অন্যান্য জলজ জীবের জন্য ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকা, ম্যাঙ্গানিজ এবং লৌহ প্রয়ােজন । জৈব এবং অজৈব সার প্রয়ােগের মাধ্যমে
নতে এদের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে । চাষের পুকুরে ঝিনুক স্থাপন : ঝিনুক রাখার জন্য আড়াআড়িভাবে পুকুরে নাইলনের। মােটা রশি টানাতে হবে । রশির দুইপ্রান্ত বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধতে হবে । পরিমাণমত ফ্লোট বা ভাসান যুক্ত করে রশিটিকে ভাসমান রাখতে হবে । ঝিনুক। নেটের ব্যাগে রেখে দড়ির সাহায্যে নাইলনের সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দিতে হবে । শরৎ হেমন্ত ও বসন্তে নেট ব্যাগ স্থাপনের গভীরতা হবে ২০ সেমি. এবং গ্রীষ্মে হবে ৩০৩৫ সেমি.। বড় জলাশয় হলে সেক্ষেত্রে বানা দিয়ে ছােট করে নেওয়া যেতে পারে। প্রতি শতাংশে ৮০-১০০ হারে ঝিনুক মজুদ করলে মুক্তার বৃদ্ধি ভাল হয়।
পুকুরে পাংকটন জন্মাবার পরপরই রুই, গ্রাসকার্প, মৃগেল ইত্যাদি মাছের পােনা। (কমপক্ষে ৫ সেমি. দৈর্ঘ্যের) পুকুরে ছাড়তে হবে । এভাবে মিশ্রচাষে প্রতি শতাংশে। ৮০-১০০টি ঝিনক সহ ৮-১০ ইঞ্চি আকারের রুই ও কাতলের পােনা ছাড়া উত্তম। আধুনিক পদ্ধতিতে দড়ির সাথে নেট ব্যাগে ঝিনুক ঝুলিয়ে চাষ করা হয়। প্রতিটি নেট ব্যাগে ২-৩ টি করে ঝিনুক রাখতে হবে । দুটি নেট ব্যাগের মধ্যে দূরত্ব থাকবে। ৪০-৪৫ সেমি. এবং দুইটি রশির মধ্যে দূরত্ব হবে ১.২-১.৫ মিটার। এছাড়া সরাসরি পুকুরের তলদেশে ছেড়েও ঝিনুক চাষ করা যায় । ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদনের জন্য কমপক্ষে ৩ বৎসর সময় লাগে । ঝিনুক ও মাছের সমন্বিত চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল ১ম, ২য়, ৩য় বৎসর মাছ বিক্রি করে ও ৩য় বৎসরে ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব । অপারেশনকৃত ঝিনুককে মাছের পুকুরে মাছের সাথে একত্রে চাষ করা সম্ভব। মাছ চাষে যে। ব্যবস্থাপনা ব্যবহার করা হয় একই ব্যবস্থাপনা মুক্তা চাষে ব্যবহৃত হয়। মুক্তা চাষে। বাড়তি কোন খাবারের প্রয়ােজন নেই। পুকুরে কেবল নিয়মিত চুন ও সার প্রয়ােগ। করতে হবে।
বাংলাদেশে মুক্তা চাষের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা
পৃথিবীর অনেক দেশই মুক্তা চাষে সফলতা লাভ করলেও বাংলাদেশে। বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ শুরু হয়নি। তবে বাংলাদেশে মুক্তা চাষের সমূহ সম্ভাবনা। রয়েছে কারণ :
• আমাদের রয়েছে বিপুল পরিমাণ জলরাশি যেখানে স্বাদুপানির মাছের সাথে সাথী
ফসল হিসেবে সহজেই মুক্তা চাষ করা সম্ভব। এ দেশের জলবায়ু ও প্রকৃতি মুক্তা চাষ উপযােগী। • ঝিনুক চাষে সম্পূরক খাদ্যের প্রয়ােজন হয় না । ব্ল্যাক কার্প ও ছেকে খাদ্য খায়।
এমন মাছ ব্যাতিরেকে অন্যান্য মাছের সাথে মুক্তা চাষ লাভজনক। এ ক্ষেত্রে।
মুক্তা মাছের সাথে বাড়তি ফসল হিসাবে পাওয়া যায়। ০ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে গ্রামীণ যুবমহিলারা ৩/৪ দিনের প্রশিক্ষণে ঝিনুক অপারেশনে দক্ষ হয়ে উঠে। ফলে দেশের পল্লী এলাকায় যুবমহিলারা মুক্তা চাষে প্রশিক্ষিত করা গেলে তারা বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে । ০ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই পুকুর/দিঘী থাকে। তাই মুক্তা চাষে গ্রামীণ মহিলাদের নিয়ােজিত করা গেলে তা নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক হবে। সার্বিক বিবেচনায় মুক্তা চাষের সীমাবদ্ধতাগুলাে দূর করা গেলে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষের সম্ভাবনা বিপুল ।
বাংলাদেশে প্রচুর পুকুর, দিঘী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় নদী-নালা আছে যা মুক্তা চাষ উপযােগী। মুক্তা উৎপাদনের পাশাপাশি ঝিনুকের খােলস দিয়ে বােতাম, ফুলদানি, খেলনা, পুতুল, নারীর অলঙ্কার ও গৃহ সাজানাের বিভিন্ন উপাদানও প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। প্রণােদিত উপায়ে ঝিনুক থেকে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি অনেকটা সূচি শিল্পের মত যা গ্রামীণ মহিলারা সহজে আয়ত্ত করতে পারে। তাই মুক্তা চাষে। নারীদের নিয়ােজিত করা গেলে জলাশয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের পাশাপাশি গ্রামীণ । মহিলাদের দারিদ্র বিমােচনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে।
*******************************************************************************
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content