ডলফিন সংরক্ষণ


সাধারণভাবে জলজ ছােট জাতের স্তন্যপায়ী প্রাণিই ডলফিন। অন্যান্য জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণির মাঝে রয়েছে তিমি ও ডুগং মাছের সাথে ডলফিনের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে । ডলফিনের শরীরে ছােট ছােট লােম আছে, এরা বাচ্চা প্রসব করে। ও বাচ্চা ডলফিন কমপক্ষে এক বছর মায়ের সঙ্গ ছাড়া বাঁচে না। ডলফিন উষ্ণ রক্তের প্রাণি, ফুসফুস আছে ও শ্বাস গ্রহণের জন্য তাকে অবশ্যই পানির উপরে আসতে হয়। অপরদিকে, মাছের দেহ সাধারণত আঁইশে আবৃত, ডিম থেকে পােনা। বা বাচ্চা হয় এবং পােনা স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে। মাছ শীতল রক্তের প্রাণি ও ফুলকার সাহায্যে পানি হতে অক্সিজেন নিয়ে থাকে। ডলফিন প্রাণিভােজী- মাছ, । চিংড়ি ও কাকড়া খেয়ে বেঁচে থাকে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির ডলফিন। ইরাবতী ডলফিন Orcaella brevirostris : আইইউসিএন এর তথ্য অনুযায়ী। অতিবিপন্ন প্রজাতির গােল মাথা বিশিষ্ট সুস্পষ্ট ঠোট ছাড়া এ প্রকার ডলফিন ১ । মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের পৃষ্ঠ পাখনা ছােট ও ত্রিকোনা । গায়ের রং পিঠের দিকে ধুসর, পেটের দিকে সাদা। এরা মিঠাপানির নদী হতে লবণাক্ত বা আধা-লবণাক্ত পানিতে বাস করে। লবণাক্ত পানিতে সাধারণত প্যারাবন বিধাত এলাকায় ইরাবতী ডলফিন বেশি দেখতে পাওয়া যায় । ইরাবতী ডলফিন খুবই সামাজিক, সাধারণত ১-৫টি দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের ৯০ শতাংশই বাংলাদেশের জলসীমা বিশেষত সুন্দরবন উপকূলে। ‘সােয়াচ অব নাে গ্রাউন্ড এলাকায় দেখতে পাওয়া যায় । আমাদের সুন্দরবনের নদী-খালে প্রায় ৪০০টি ও সুন্দরবন সন্নিহিত সাগর উপকূলে ৫,৫০০টি ইরাবতী ডলফিন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

নদী বা সাগরে ডলফিনের উপস্থিতি স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ইঙ্গিত বহন করে। উপকূল ও সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণে তাই ডলফিনের গুরুত্ব অনেক। সাধারণত । কক্সবাজার ও টেকনাফের সাগর উপকূলে কিংবা মাছ অবতরণ কেন্দ্রে মৃত । ডলফিনের দেখা মিললে খবরের পাতায় তা আসে। কিন্তু আমাদের বিস্তৃত সমুদ্র । উপকূলে ডলফিন ধরা বা মারা যাওয়ার খবরের কতটুকুই আমরা জানতে পারি।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, চীন, ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়াতে এদের দেখতে পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন উপকূলে ‘সােয়াচ অব নাে গ্রাউন্ড’ অঞ্চলে ১,৭৩০ বর্গকিলােমিটার এলাকায় ডলফিনের আধিক্যের কারণে। দেশের প্রথম সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা (Marine Protected Area) ঘােষণা করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষত পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সুন্দরবনের নদীতে মিঠাপানির প্রবেশ বাধাগ্রস্থ হওয়ার এদের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখিন । মাছ ধরার বড় ফাঁস জাল, ইলিশ জাল, বেহুন্দি জাল বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে হাঙ্গর ও শাপলা পাতা ধরার জালে আটকা পড়ে এরা মারা পড়ে। কক্সবাজার উপকূলে বিগত বছরগুলােতে বেশ কিছু মৃত ইরাবতী ডলফিন পাওয়া। গেছে। ধারণা করা হচ্ছে জেলেদের জালে ধরা পরার পর এদের তীরে ফেলে দেওয়া হয়।

হামব্যাক বা গােলাপী ডলফিন Sousa chinensis : লম্বা ঠোট ওয়ালা সর্বোচ্চ ২.৮ মিটার দৈঘ্যের এ জাতের ডলফিন আমাদের উপকুলে প্রায়শই দেখা মিলে। এদের বাঁকানাে পৃষ্ঠ পাখনা দেহের পিছনের দিকে অবস্থিত ও দেহবর্ণ নীলাভ ধূসর হতে গােলাপী আভার দুধ রঙ্গের হয়ে থাকে। হামব্যাক ডলফিন বড় দলে প্রায় ১০টি করে চলাফেরা করে। এরা দক্ষিণ আফ্রিকা হতে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ চীন হয়ে কুইনসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।


সুন্দরবন সহ আমদের  উপকূলে এ জাতের ২০০টি ভলকিন রয়েছে বলে ধারণা করা ।

বটলনেক ডলফিন Tursiops aduncus : বোতল আকৃতির ঠোটের জন্য নাম দেওয়া এ জাতের ডলফিন প্রায় ২.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। অন্যান্য জাতে ডলফিনের তুলনায় এদের পাখনাগুলাে বেশ বড়। বের হতে কাল রঙ্গের বটলনেক। ভলকিনের সংখ্যা আমাদের উপকুলের ‘সােয়াচ অব নাে গ্রাউন্ড এ ২,০০০ এর । উপরে, বা না বিশ্বে দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় একক পপুলেশন।

চিত্রা ডলফিন  Stenella attenuata : একটি পূর্ণবয়স্ক চিত্রা ডলফিন আকারে ১.৬-১.৬ এর পর্যন্ত হতে পারে। এদের দেহ চোঙ্গতি ও লম্বা এবং সরু লম্বা ঠোট বিদ্যমান ।  দেহে ফোটা ফোটা দাগের এ জাতের ডলফিন পৃথিবীর প্রায় সব সমুদ্রু উপকূলে দেখতে পাওয়া যায় । সুন্দরবন উপকূলে ‘সােয়াচ অব নাে গ্রাউন্ড’ অঞ্চলে এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় । এদেশে চিত্রা ডলফিন সম্পর্কে বেশি তথ্য জানা যায় নি । 

ঘূর্ণী ডলফিন  Stenella longirostris ; দেহ অক্ষ বরাবর লাফ দেওয়ার স্বভাব ও ঘূর্ণীর জন্য এদের এই নামকরণ । বেশ লম্বা ঠোঁটের নলাকৃতিরঘূর্ণী ডলফিন দৈর্ঘে ২-২৪ এর হয়ে থাকে। এদের পৃষ্ঠ পাখনা ত্রিকোনা থেকে বাঁকানাে। তিনটি রঙ্গের মিশ্রিত এদের দেহ বর্ণ পিঠের অংশ কালাে, দুই পার্শ্বে ধুসর ও পেটের অংশ সাদ। বাংলাদেশে ঘূর্ণী ডলফিন সম্পর্কে বেশি তথ্য জানা যায়নি যদিও ‘সােয়াচ অব নাে গ্রাউন্ত অঞ্চলে এদের উপস্থিতি রয়েছে ।

গাঙ্গেয় ডলফিন Platanista gangetica gangetica : স্থানীয়ভাবে শুশুক নামেই এরা বেশি পরিচিত। এর প্রথম আবিস্কার ঘটে ভারতের গঙ্গা নদীতে। পরবর্তীতে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে এদের সরব উপস্থিতি দেখা যায় । পূর্বে দেশের প্রায়। সব বড় নদীতে দেখা মিললেও বর্তমানে কর্ণফুলি, মেঘনা, ডাকাতিয়া, পদ্মা, যমুনা। ও সুন্দরবনের নদীতে কিছু পরিমাণে এদের দেখা যায়। সাধারণত এদের সাগর উপকূলে দেখা মিলে না। একটি পূর্ণাঙ্গ শুশুক ১.৫-২.৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯০ কেজি। ওজনের হয়ে থাকে। এরা একত্রে ১৫-২০ টি পর্যন্ত দল বেঁধে চলাচল করে। কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর মােহনায় প্রায় ২০০টি গাঙ্গেয় ডলফিন দেখতে পাওয়া যায় । আইইউসিএন এর তথ্য অনুয়ায়ী বাংলাদেশে শুশুক একটি বিপন্ন প্রজাতি।

ডলফিন খুব বুদ্ধিমান প্রাণি হিসেবে বিবেচিত। এরা রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও। প্রায়শই এরা জেলেদের উপকার করে থাকে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এদেশের প্রায়। সকল নদ-নদীতে এক সময় শুশুক’ দেখা যেত, কিন্তু নদীতে সবসময় পর্যাপ্ত পানি ও খাদ্য না থাকা এবং দূষণের কারণে নদ-নদীতে এদের এখন দেখাই যায় না । সাম্প্রতিক এক গবেষণা পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের সুন্দরবন ও সংলগ্ন সাগর। উপকূলে প্রায় ১১ প্রজাতির ডলফিন রয়েছে বলে জানা যায়। সুন্দরবন সংলগ্ন ‘সােয়াচ অব নাে গ্রাউন্ড’ অঞ্চলে পৃথিবীতে অতিবিপন্ন প্রজাতির ৫,০০০ ইরাবতী ডলফিন দেখা গেছে যা বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের মােট সংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ । তাই বাংলাদেশের সাগর উপকূল বিশ্বে ডলফিনের অন্যতম বাসস্থান হিসেবে বিবেচিত।

আমাদের জেলে সম্প্রদায় এলফিনকে তাদের বন্ধু বা সাগরে সাহায্যকারী বলে মনে করে। তারা সরাসরি ডলফিন না মারলেও মাঝে মাঝে জালে আটকা পড়ে ও দুর্ঘটনাবশত মারা যায়। তাই এলকিন রক্ষায় জেলে সম্প্রদায়সহ সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। ডলফিন রক্ষার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য জলজ প্রাণি সংরক্ষণ | তথা জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারি।

আমাদের করণীয়

• সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে । বিপন্ন প্রাণি ডলফিন জালে ধরা পড়লে তাকে বের হয়ে যাওয়ার সুযােগ করে দিতে হবে । - কারেন্ট জাল ও অন্যান্য ছােট ফাঁসের ফাঁস জাল দিয়ে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে। • উপকূলে মানবসৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post