দেরি করে ওঠা ও অসময়ে ঘুম, এখনকার সময়ের সমস্যাগুলো নিয়ে পরামর্শ দিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসকরা>> Clue The Wall Online News Portal 

‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে’…

সেই কোন ছোটবেলায় পড়া কবিতা এখনও প্রাসঙ্গিক। ‘আলসে নয় সে ওঠে রোজ সকালে’, কবি সেই কবেই বলে গিয়েছিলেন আলসেমি ছেড়ে, ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠাই দস্তুর। কিন্তু সব পরামর্শই সার। 



খোকাখুকিরা মোটেও এখন ভোর বেলা ওঠে না। তারা রাত জাগে, বেলা কাটিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। তবে খোকাখুকিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, বড়রাও এখন সব নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতেছেন। রাত জেগে মোবাইল-ল্যাপটপ, সকালে দেরি করে ঘুম ভেঙেই একরাশ বিরক্তি আর ক্লান্তি। দু’চোখে ঘুম ঘুম ভাব। পেশাগত কারণে রাত জাগতে হয় যাঁদের, তাঁরা বেলা গড়িয়ে গেলে বিছানায় কাত হওয়ার সুযোগ পান। দিনের বেলায় কটকটে আলো আর খুটখাট আওয়াজে সেখানেও ঘুমের দফারফা।

Read More জরায়ুমুখ ক্যানসার থেকে বাঁচুন

“ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত”….গুনগুন করে এই গান ভেঁজেও ঠিক ঘুমটা আসে না। এই যে ঘুম আসছি আসছি করেও আসে না, তার অনেক কারণ। ডাক্তাররা বলেন ঘুম না আসাটাই একটা রোগ। শরীরেরও তো একটা ঘড়ি আছে। সেও কাঁটায় কাঁটায় চলতে চায়। খিদে পাওয়ার যেমন সময় আছে, ঘুমেরও তেমনি সময় আছে। হাড়-মাংস-পেশী সমেত একটা শরীরকে চালানোর ধকল তো কম কিছু নয়! একটা সময় আসে যখন পেশীরাও বিশ্রাম চায়, স্নায়ুরা ঝিমিয়ে পড়ে, চোখের পাতা ঝাঁপ বন্ধ করতে চায়। 

তখনই ঘুম নেমে আসে। আর ক্লান্ত শরীরেও যদি ঘুম না আসে তার মানেই গণ্ডগোল বেঁধেছে ধরে নিতে হবে। তখন অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া, স্লিপিং ডিসঅর্ডার নানা ভারী ভারী অসুখের নাম উঠে আসে।

ঘুমের সমস্যার দুটো দিক এখনকার সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে সবচেয়ে বেশি চর্চিত—এক, রাত জাগা ও দেরি করে ওঠার অভ্যাস, দুই, স্লিপিং ডেপ্রিভেশন বা ঘুম আসতে না চাওয়া, ঘুমের ঘাটতি ইত্যাদি। ঘুম নিয়ে এখন এত মাথা ঘামাচ্ছেন লোকজন, এতরকম সমস্যা, বিশিষ্ট চিকিৎসকরা কী বলছেন জেনে নিন। 

সকালে ঘুম, দুপুরে ঘুম, রাত-জাগা, তারপরেও অভিযোগ

ঘুম নিয়ে অভিযোগ অনেক। ঘুম হচ্ছে না রাতে, ভোরের দিকে হাল্কা ঘুম, ফলে উঠতে দেরি। সারাদিন ক্লান্তিভাব, বিরক্তি, শরীরজুড়ে অস্বস্তি। অনেকে আবার রাত জাগতে ভালবাসেন, ফলে সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়, তারপরেও সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকে। প্রবীণরা তো বটেই, কমবয়সীদেরও ঘুম নিয়ে এমন নানা অভিযোগ-অনুযোগ।




এ ব্যাপারে জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার (পশ্চিমবঙ্গ শাখা) সহ-সম্পাদক, প্রোটেক্ট দ্য ওয়ারিয়র্স ও পিডিপিডব্লুএসকে-র উপদেষ্টা ডাঃ ধীরেশ কুমার চৌধুরী বলছেন, বয়স্কদের অনেককেই দেখা যায় সকালে উঠেও খানিক ঘুমিয়ে নেন। দুপুরে খাওয়ার পরে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমোন। ফলে রাতে ঘুম আসতে চায় না। তখনই সমস্যার শুরু। ডাক্তারবাবু বলছেন, আসলে আমাদের শরীরে একটা ঘড়ি আছে, যা নিয়ম মেনে চলে। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়া, ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। এই নিয়মটার ব্যতিক্রম হলেই ঘুমের সমস্যা শুরু হয়, তার থেকেই অনিদ্রা, স্লিপিং ডিসঅর্ডার নানা রোগ ধরে যায়।

ঘুম হচ্ছে না কেন এই প্রশ্ন নিয়ে যাঁরা আসেন, তাঁদের হিস্ট্রি পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে, সারাদিনই কোনও না কোনওভাবে তাঁরা ঘুমের চাহিদা মিটিয়ে নেন। দুপুরে ঘণ্টাখানেক ঘুমনোর অভ্যাসও থাকে অনেকের। তাছাড়া রাত জেগে বই পড়া, টিভি দেখা, গান শোনা বা সিনেমা দেখার অভ্যাস তৈরি করে ফেলেন অনেকে। এই কারণেও ঘুম আসতে দেরি হয় বা ঘুম ঠিক করে হয় না।

ডাক্তারবাবু বলছেন, রাতের খাওয়া ও ঘুমোনোর মধ্যে ঘণ্টাখানেকের ব্যবধান রাখতে হবে। রাতে কোনও রকম উত্তেজক আলোচনা বা বই পড়া, সিনেমা বা সিরিয়াল দেখার অভ্যাস থাকলে তা ছাড়তে হবে। ঘুমনোর আগে মস্তিষ্ককে বেশি উত্তেজনা দিলে স্নায়ুগুলো অ্যাকটিভ হয়ে থাকে, ফলে সহজে ঘুম আসতে চায় না।

প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি কোথায়?

রাত ৯টায় ঘুমিয়ে পড়ায়, ভোর রাতে উঠে শরীর চর্চা, দুপুর ও রাতের খাওয়া সময়ের মধ্যে—প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নিয়মগুলো মানা হচ্ছে কোথায়? ছোটরা বিকেলে খেলাধূলা করবে, সাড়ে ৭টার মধ্যে ঘুমোবে, বড়রা বিছানায় যাবে রাত ৯টার মধ্যে, ভোর থাকতে উঠে শরীরচর্চা করবে তবে না শরীরের সিস্টেম সচল ও সক্রিয় হবে, এমনটাই বলছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ পার্থসারথি ভট্টাচার্য।

ডাক্তারবাবু বলছেন, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা চলছি না, তাই হাজারটা অসুখ। ঘরে ঘরে ওবেসিটির রোগী। ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ জাঁকিয়ে বসেছে। অনিদ্রার রোগী ঘরে ঘরে। চারপাশে শুধুই অসুস্থ মানুষের ভিড়, সুস্থ লোকজন দেখতে পাওয়া যায় কোথায়! সমস্যা থাকবে, কিন্তু তার সমাধান গোড়ায় গিয়ে দেখতে হবে। নিয়ম মানা আগে শুরু হোক, তারপর অভিযোগের পালা আসবে। শরীর তার নিয়মের সঙ্গেই খাপ খাওয়াতে চায়, সেই চেষ্টা আগে করতে হবে।

স্লিপ-হাইজিন মানতে হবে, শরীরকে খাপ খাওয়াতে হবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গেই

স্লিপ-হাইজিন সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্ট ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ডাঃ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, কম ঘুম, অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া থাকলে স্লিপ ডিপ্রাইভেশন হতে পারে। দিনের বেলাতেও ঘন ঘন ঘুম পাবে। ঘুম ভেঙে ওঠার পরেও ক্লান্ত লাগবে, সারাদিন শরীরে অস্বস্তি থাকবে। মেজাজ খিটখিটে হতে পারে। নাক ডাকা, স্লিপ অ্যাপনিয়া থেকে হতে পারে। ঘুমের মধ্যেই ঘন ঘন চোখের নড়াচড়া বা আই মুভমেন্ট হবে।

দিনে কম করেও ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা টানা ঘুম দরকার। তবেই বর্তমান লাইফস্টাইলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া যাবে। ঘুম না হলেই বিপদ আসবে নানা ভাবে। আবার বেশি ঘুম হলেও শরীর ভোগাবে, হার্টের রোগ হানা দেবে। অতিরিক্ত চিন্তা, টেনশন থেকে মানসিক রোগে ধরবে, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড একে একে সবই আসবে হুড়মুড়িয়ে।

ক্লান্তিহীন নিশ্চিন্ত ঘুম পেতে হলে কিছু নিয়ম মানতেই হবে। ওষুধের বদলে বরং মানসিক স্থিতিতে কাজে দেয় বেশি। প্রতিদিন শোয়ার আগে কিছুক্ষণ মেডিটেশন করতে। মন শান্ত রেখে প্রাণায়াম বা যোগব্যায়ামে খুব দ্রুত কাজ হয়। রাতের খাওয়া আর ঘুমের মধ্যে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টার বিরতি থাকতে হবে। এই সময় হাঁটাহাঁটি করলে খাবার হজম হয় দ্রুত। পাকস্থলী শান্ত থাকে, অম্বলের বাড়বাড়ন্ত হয় না। ঘুমও হয় সুন্দর, শরীরে চাহিদা মাফিক। অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনা না করাই ভাল, বিশেষত ঘুমনোর সময়। স্ট্রেস ফ্রি হয়ে ঘুমোতে যান।

পেশাগত কারণও থাকতে পারে। প্রতিযোগিতার দৌড়ে সারাদিনই কম্পিউটার, ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকলে মাথায় চাপ পড়ে। স্নায়ুরা বিদ্রোহ করে। রাতে শুয়েও অনেকের মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করার অভ্যাস আছে। ডাক্তাররা বলেন, মোবাইলের নীল আলো সরাসরি মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করে। ঘুমের ব্যাঘাত হয়। দিনের পর দিন এমন চালালে ক্রনিক স্লিপিং ডিসঅর্ডারও হতে পারে। যারা নাইট শিফট করে, তাদের পর্যাপ্ত ঘুমের দরকার হয়। সেক্ষেত্রে রাতে কাজ করলেও প্রতি দুঘণ্টা সময়ের বিরতিতে পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে নেওয়া ভাল। ১৫ মিনিট করেও যদি ঘুমোতে পারেন তাহলে তা কাজে দেবে। আইটি সেক্টর, সাংবাদিকতা ইত্যাদি পেশার সঙ্গে জড়িতদের রাত জেগে কাজ করতেই হয়। অফিস শেষ হলে বেলায় ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। তখন মনে চিন্তা আসে দিনের বেলায় ঘুম হবে কী করে, এই চিন্তা থেকেই ঘুমের বারোটা বেজে যায়।

দেরি করে ঘুমোতে যেতেই হবে যাঁদের তাঁরা আরও কিছু নিয়ম মানতে পারেন। যেমন সারা রাত কাজ করে ঘুমোতে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, তখন দিনের আলো , চারদিকে আওয়াজ এসব সামলে ঘুমনো সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার। তাহলে কী করণীয়?

ঘুমনোর আগে চা, কফি বা ঠাণ্ডা পানীয় না খাওয়াই ভাল। সিগারেট টেনে ঘুমোতে যাওয়াও খুব একটা ভাল অভ্যাস নয়। এতে ঘুমের ক্ষতি তো হয়ই, শরীরেও তার ছাপ পড়ে।

রাতের খাওয়া আর ঘুমের মধ্যে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টার বিরতি থাকতে হবে। এই সময় হাঁটাহাঁটি করলে খাবার হজম হয় দ্রুত। পাকস্থলী শান্ত থাকে, অম্বলের বাড়বাড়ন্ত হয় না। ঘুমও আসে তাড়াতাড়ি।

অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনা না করাই ভাল, বিশেষত ঘুমনোর সময়। স্ট্রেস ফ্রি হয়ে ঘুমোতে যান।

মেডিটেশন ঘুমের জন্য আদর্শ দাওয়াই। চোখ বন্ধ করে সংখ্যা গুনতে পারেন কাজ দেবে। ঘরের আলো নিভিয়ে বা হাল্কা আলো জ্বালিয়ে মেডিটেশন করুন, ফল পাবেন।

আলো এলে ঘরে ভারী পর্দা লাগান, বিছানা-বালিশ যাতে ঠিকমতো থাকে, পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন।

ডাক্তার অনিন্দিতা বলছেন, কর্পোরেট হাউসের থেকে চোখ ফিরিয়ে সমাজের অন্যদিকে তাকান। দেখবেন সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতারা রাত থাকতেই উঠে জিনিসপত্র কিনতে যান। বহু দূর থেকে মালপত্র নিয়ে ট্রেনে চেপে কষ্ট করে ফেরেন। তাঁরাও কিন্তু শরীরকে সে ভাবেই মানিয়ে নিয়েছেন। পেশার কারণে তাঁদেরও রাত জাগতে হয়, নিয়মের বাইরে গিয়ে শরীরকে মানাতে হয়। সেটাও একটা প্রচেষ্টা। শরীর ও মনকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন, তারাও সেভাবই সাড়া দেবে। মনের শক্তিও সেখানে বড় ব্যাপার। এদিকটা ভেবে দেখলে সমস্যার সমাধান বের করা অনেক সহজ হবে।

Clue The Wall Online News Portal 


Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post