সারগ্যাসো সাগর, পৃথিবীর একমাত্র সমুদ্র যার কোনও তীর নেই

সাগরটি দৈর্ঘ্যে ৩২০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার।  

এখানে হরহামেশাই অনেক জাহাজ শৈবালে আটকে ডুবে যায়

 সাগর আছে কিন্তু তার কোনও তীর নেই। ব্যাপারটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতোই অবাস্তব মনে হয়। কিন্তু জানলে বিস্মিত হবেন, সত্যিই আছে এ রকম সাগর। না অন্য কোনও গ্রহে নয়, আছে এই পৃথিবীতেই। প্রকৃতির এই অনবদ্য সৃষ্টিটি লুকিয়ে আছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে। তীর না থাকা সাগরটির নাম সারগ্যাসো সাগর (sargasso)। সাগরটি দৈর্ঘ্যে ৩২০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার। সারগ্যাসো সাগরই পৃথিবীর একমাত্র সমুদ্র, যার কোনও তীর নেই।

READ MORE: হিমালয়ে লুকিয়ে বিশুদ্ধ আর্যদের গ্রাম! ইউরোপ থেকে আসেন রহস্যময়ী নারীরা!

সারগ্যাসো সাগর

তীরের বদলে সারগ্যাসো সাগরটিকে ঘিরে আছে আটলান্টিক মহাসাগরের চার ধরনের স্রোত। সারগ্যাসো সাগরের পশ্চিমে আছে গালফ স্ট্রিম, উত্তরে আটলান্টিক কারেন্ট, পূর্বে ক্যানারি কারেন্ট এবং দক্ষিণে নর্থ-ইকুয়েটোরিয়াল কারেন্ট। এই চারটি স্রোত চক্রাকারে ঘুরে চলেছে অবিরাম। চারটি স্রোতের মাঝে থাকা সারগ্যাসো সাগরের জল স্থির ও প্রবাহহীন। তাই উত্তাল আটলান্টিক মহাসাগরের সব চেয়ে শান্ত অঞ্চল এই সারগ্যাসো সাগর।

রোদ্রৌজ্জ্বল দিনে পানির ২০০ ফুট নিচ পর্যন্ত দেখা যায়


ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে আলমোরাভিদ সাম্রাজ্যের সুলতান আলি ইবন ইউসুফ একটি জাহাজ পাঠিয়ে ছিলেন  এই এলাকায়। জাহাজে ছিলেন বিখ্যাত মানচিত্র-নির্মাতা মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসি। তিনি সাগরটির মানচিত্র নির্মাণ করেছিলেন।

মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসি

সারগ্যাসো সাগরকে রহস্যের খনি বলে বর্ণনা হয়েছিল অনেক বিখ্যাত উপন্যাসে। চতুর্থ শতাব্দীর লেখক রাফাস ফেস্টাস অ্যাভেনিয়াসের লেখাতে এই সাগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। উইলিয়াম হোপ হজসনের লেখা উপন্যাস ‘দ্য বোট অফ দ্য গ্লেন ক্যারিগ’, ভিক্টর অ্যাপেলটনের লেখা ‘ডন টার্ডি ইন দ্য পোর্ট অফ লস্ট শিপস’, জুলে ভার্নের লেখা ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ উপন্যাস ছাড়াও আরও অসংখ্য উপন্যাস ও গল্পে সারগ্যাসো সাগরের কথা লেখা আছে।

পুরো সাগর ভরে আছে সারগাসম নামে সামুদ্রিক শৈবালে


সারগ্যাসো সাগর

সাগরটির নাম সারগ্যাসো দিয়েছিল পর্তুগিজরা। সাগরের বুকে তারা দেখেছিল সারগাসম (Sargassum) নামে সামুদ্রিক শৈবালটির অস্বাভাবিক প্রাচুর্য। তাই তারা শৈবালটির নামেই সাগরটির নাম দিয়েছিল সারগ্যাসো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাহাজের নাবিকদের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে আছে সারগ্যাসো সাগরটি।

সাগরের উপরিভাগ এভাবেই ঢেকে রেখেছে শ্যাওলার স্তর।

সাগরটির কোনও কোনও জায়গায় শৈবালের স্তর এতোই পুরু হয়, যে সেখান দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারে না। এছাড়া জলের স্রোত না থাকায় স্রোতের সাহায্যও পায় না জাহাজ। ওইসব জায়গা দিয়ে জাহাজ চালাতে গেলে জাহাজের প্রপেলারে শ্যাওলা জড়িয়ে প্রপেলার বন্ধ হয়ে যায়। একই জায়গায় আটকে থাকে জাহাজ। উন্মত্ত বাতাসের ঝাপটায় দুলতে শুরু করে। ছোট বোট হলে ডুবে যায়।

সারগ্যাসো সাগর আজ হয়ে উঠেছে প্লাস্টিকের ডাস্টবিন


সারগ্যাসো সাগরে ডুবে গেছে জাহাজ।

শোনা যায় একবার একটি ইউরোপীয় জাহাজ সারগ্যাসো সাগরে ঢুকে পড়েছিল। জাহাজে ছিল প্রচুর ঘোড়া। ঘোড়াগুলি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বিক্রির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সারগ্যাসো সাগরে ঢোকার পর রুদ্ধ হয়েছিল জাহাজের গতি। জাহাজ আটকে গিয়েছিল শ্যাওলায়। জাহাজের ওজন কমিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সব ঘোড়া জলে ফেলে দিয়েছিল নাবিকরা।

চারদিকের জল বয়ে নিয়ে এসেছে শ্যাওলা।

কিন্তু আটলান্টিকের মাঝে কী করে এসেছে এতো শৈবাল! আসলে সারগ্যাসো সাগরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা জলের স্রোতই বয়ে নিয়ে এসেছিল সামুদ্রিক শৈবাল। সেগুলি জমা করেছিল সারগ্যাসো সাগরের বুকে। এখনও প্রতিনিয়ত জমা করে চলেছে। এভাবেই সারগ্যাসো সাগর একদিন হয়ে উঠেছিল ‘শৈবাল সাগর’। শৈবালের ফাঁদে পড়ে জল হয়ে উঠেছিল স্রোতহীন ও শান্ত।

৩৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা সারগ্যাসো সাগরের জল অস্বাভাবিক রকমের স্বচ্ছ। জলের রঙ ঘন নীল। উজ্জ্বল দিনে জলের নীচে ২০০ ফুট পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়। আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সবচেয়ে লবণাক্ত অঞ্চলও এই সারগ্যাসো সাগর। 

সারগ্যাসো সাগরে দেখতে পাওয়া যায় জৈববৈচিত্রের প্রাচুর্য্য। খাদ্যের বিপুল সম্ভার এবং শ্যাওলার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সুবিধা জনক বলে, বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক প্রাণী বাস করে এই সারগ্যাসো সাগরে। ডিম পাড়ার সময় আটলান্টিকের বিভিন্ন জায়গা থেকে সারগ্যাসো সাগরে চলে আসে আমেরিকান ও ইউরোপীয় ইলের দল।

ডিম পাড়তে এসেছে ইল।

তবে মানুষের জন্যেই আজ প্লাস্টিকের ডাস্টবিন হয়ে উঠেছে সারগ্যাসো সাগর। দূষণ ছড়াচ্ছে সারগ্যাসো সাগর থেকে চারদিকের জলস্রোতে। এর ফলে আটলান্টিক মহাসাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে দূষণ ।

READ MORE: বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী, তবু কোনও ব্রিজ নেই আমাজনের উপর! কেন জানেন

সারগ্যাসো সাগরে জমা হয়েছে প্লাস্টিক।

তবে সুখের কথা, পর্তুগালের স্বশাসিত আজোর দ্বীপপুঞ্জ, বারমুডা, মোনাকো, ব্রিটেন ও আমেরিকাকে নিয়ে ২০১৪ সালের ১১ মার্চ গড়ে উঠেছে ‘সারগ্যাসো সি কমিশন’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে ‘সারগ্যাসো সি কমিশন’ ঝাঁপিয়ে পড়েছে সারগ্যাসো সাগরকে বাঁচাতে।

সারগ্যাসো সি কমিশন কাজ করছে সারগ্যাসো সাগরকে বাঁচাতে

আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নীচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন ।   কোন সাজেশন থাকলে নির্ধিদায় আমাদের কে জানান, কমেন্টস করুন । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ 



Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post