কেন কিভাবে কি কারনে ধ্বংস হলো  ঐতিহ্যবাহী শালবন  

শালবন।
ঝরা পাতার শালবন ঐতিহ্যবাহী ও সুপরিচিত, বিশেষ করে দেশের  উত্তরমধ্যাঞ্চলের মানুষের কাছে। মধুপুর গড় এবং ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর ও মাহী জেলাসমূহে শালবন বিস্তৃত তবে বর্তমানে   শালবনের যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা ঐতিহ্যগত শালবনের প্রতিনিধিত্ব করে না।

শালবনের অধিকাংশই বিনষ্ট হয়েছে বা শালবনের মাটি বেদখল হয়েছে অসাধু বা ব্যবসায়ী কলা-আনারস চাষি এবং বাণিজ্যিক বনায়নের (রাবার ও জ্বালানী কাঠের বন) জন্য নিয়জিত সরকারি  কর্তৃপক্ষের হাতে  

দেশের সবচাইতে বড় শালবন মধুপুর গড়ের  শোচনীয় অবস্থা দেখে অন্যান্য শালবনের করুণ অবস্থা অনুমান করা যায় ।।

শালবনে এক সময় ৭০ শতাংশের মতো গাছ ছিল শাল।
 কিন্তু বর্তমানে শালবন এমনভাবে বিনষ্ট হয়েছে যে অধিকাংশ জায়গায় শালবন তার শত শত বছরের ঐতিহ্য হারিয়েছে। 

কোথাও কোথাও শালকপিস গজিয়ে উঠছে তো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে অনতিবিলম্বে



ঐতিহ্যবাহী শালবনের অনেকগুলো অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শালবনের  মাটি অনেকটা হলুদ বা লাল রঙের। শাল গাছ অত্যন্ত শক্ত কাঠ উৎপাদনকারী একটি প্রজাতি। গাছটি সরু হয়ে উঠে যায় উপরের দিকে। ধীরে ধীরে বাড়লে ও প্রতি বছর এর ঝরাপাতা, ডালপালা মানুষের নানান কাজে লাগে । 

মরাপাতা মাটিতে পঁচে গলে সার হয়ে যায় এবং মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ায় । প্রতি বছর ঝরা পাতা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঐতিহ্য রয়েছে । কাজটি করে  বন বিভাগ  ঝরা পাতা পোড়ানোর পর যখন বৃষ্টি শুরু হয় তখন ছাইভস্ম মাটিতে মিশে মল  বৃক্ষসমূহের পুষ্টি সাধন করে এবং শাল ও অন্যান্য প্রজাতির নতুন চারা  বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে। 



বর্ষামৌসুমে একটি শাল গাছ থেকে উৎপন্ন হয় হাজার হাজার বীজ যা পেকে মাটিতে পড়ে। এগুলো কোথাও  পুঁতে দিলেই তা থেকে গজিয়ে উঠে শালের চারা এক সময় প্রতি বছর বন বিভাগের। তত্ত্ববধানে শালবীজ পুঁতে শাল গাছের সংখ্যা বাড়ানো হতো


শালবনে যে শতরকমের অন্যান্য ছোঁটখাটো ফুল ফলের বৃক্ষ রয়েছে তা বিশেষ করে। বর্ষামৌসুমে যে কারো নজর কাড়ে। শালবনের একটি অনন্য চারা বা কপিস বের হয় যা পরবর্তীতে শালবন পুনরুৎপাদন করে

এ বনের  বৈশিষ্ট্য হলো  একটি বড় গাছ কাটার পরপরই গাছের মোথা থেকে অনেকগুলো গজারীর চারা পুনারায় গজিয়ে উঠে যা পরবর্তীতে গজারী গাছ থেকে শাল গাছে পরিণত হয় ।
বাণিজ্যিকভাবে মূল্যবান শাল ছাড়াও শালবনে আরো অনেক মূল্যবান বৃক্ষ রয়েছে।
 এদের মধ্যে কড়ই, জোগিনিচক্র, চম্বল, কাইকা, সিধা, আমলকি, সাজনা, কালস্, সোনালু , আজুলি এবং গাওগিলা অন্যতম  (খালেক ১৯৯২:২৩ এবং টাঙ্গাইল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস ১৯৮৩:৭৬)
শালবনের মাটিতে আরো যেসব উদ্ভিদ জন্মায় যেমন সনগ্রাস, তাও অর্থনৈতিক দিক থেকে এবং পরিবেশগতভাবে মূল্যবান । শাল গাছ খুবই শক্ততাই ঘরের খুঁটি ও চাল তৈরির কাজে এ গাছটি গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে খুব প্রিয়  



শালগাছ এবং এ বনের অন্যান্য গাছ কেবল শালবনে এবং তার আশে পাশে মানুষের কাছেই প্রিয় নয়; ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং আশেপাশের অনেক জেলার মানুষের কাছে এর চাহিদা অনেক। শহরে নির্মাণ কাজে ও শালকাঠের ব্যবহার অনেক  

ইটের ভাটায় শালগাছ এবং মোথার ব্যবহার। চোখে পড়ে যদিও  বর্তমানে এর সরবরাহ অনেক কমে গেছে।
শালবন বিনষ্ট হবার কারণ অনেক। শালবনের মালিকানা বদল, বিশেষ করে ১৯৫৯ সালের ইস্ট পাকিস্তান স্টেট একুইজিসন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট শাল গাছ কাটার পেছনে উৎসাহ যুগিয়েছে। উপমহাদেশের বিভক্তি এবং বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় বন ছেড়ে দেয়া এলোপাথাড়ি ও ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের বড় কারণ।
 তবে পরিবেশবাদী এবং পেশাদার বন কর্মীরা মনে করেন অনেক জায়গাতেই ; স্বল্প খরচে যথাযথ যত্নের  মাধ্যমে শালবনের রিজেনারেশন বা পুনরুৎপাদন সম্ভব ছিল। কিছু কিছু জায়গায় এখনো তা সম্ভব শালবনের বৈশিষ্ট্যই এমন যে বড় গাছটি কেটে ফেলার পরেই আবার সেখানে দ্রুত শাল গাছের চারা বা কপিস  গজিয়ে উঠে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শালবনের রিজেনারেশনের |

পরিবর্তে সেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদেশী প্রজাতি বিশেষ করে ইউক্যালিপটাস এবং আকাশিয়া লাগানো হয়েছে । লাগানো এক, দুই বা সীমিত কয়েক প্রজাতির বনকে সরকারি পরিভাষায় বলা হয় সৃজিত  বাগান' ‘বন বাগান’ ‘সামাজিক বনায়ন' ইত্যাদি । 



লাগানো বাগান মনোকালচার এবং নির্দিষ্ট সময় (বছর দশেকের মাথায়) পর কেটে   ফেলা হচ্ছে। এর ফলে শালবনের চেহারা নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে।

প্রাকৃতিক শালবন বিনষ্ট হবার ফলে বন্য প্রাণীকূলের অধিকাংশই বিলীন হয়ে গেছে। লেপার্ড (বাঘ), ভলু ক, হরিণ এবং আরো অনেক  বন্যপ্রাণী যা মধুপুরের সর্বত্র দেখা যেত এক সময় সেসব এখন আর নেই। বানর হনুমান  এখনো কিছু দেখা যায় রাবার বাগানে বা তৈরি  করা সীমিত প্রজাতির বাগানে অতীতের অনেক পাখি যেমন, ময়ূর এবং অজগর সাপ আর দেখা যায়না ।
 তথাকথিত বনায়নের ফলে শাল ও অন্যান্য শত রকমের স্থানীয় প্রজাতি এমনভাবে বিনষ্ট হয়েছে যে শাল বনের মাটিতে বেড়ে ওঠা , ছোঁটখাট ঘাস, গাছ, চিকিৎসার কাজে লাগে এমন গাছগাছালি যায় ; শালবনের মাটি ও মাটির মধ্যে বসবাসকারী উপকারী তার ও কীটপতঙ্গেরও বিলুপ্তি ঘটছে ।
মধুপুর ও অন্যান্য জায়গায় ঐতিহ্যবাহী শালবন আজ ইতিহাস হয়ে যাবার মতো অবস্থা । বেশিদিনের কথা নয় ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ, টাংগাইল, দিনাজপুর এবং  রাজশাহী জেলাসমূহে  ১২০,০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃ৩ ছিল ঝরাপাতার শালবন । 

আজ শালবনের ঠিক কতটুকু অবশিষ্ট আছে তা বলা কঠিন । তবে যত্রতত্র যা দেখা যায় তা থেকে অনেকে আন্দাজ করেন সমগ্র শালবনের বেশি হলে ১০ শতাংশ অবশিষ্ট আছে ফরেস্ট্রি মাস্টার প্লানের (১৯৯৩ সালে সম্পন্ন) তথ্য অনুসারে কেবল টাঙ্গাইল জেলাতে ১৯৭০ সালের জায়গাতেই শত শত। ২০,০০০ হেক্টর শালবন ১৯৯০ সালে ১,০০০ একরের শালবন হেক্টরে এসে ঠেকেছে।
 তাই যদি হয় তবে বর্তমানে শালবনের পরিমাণ আরো  কমে গেছে । তবে পরিসংখ্যানের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত । বিদেশী ঋণের টাকায় বনায়ন করতে গিয়ে এমন সব বনভূমিকে বনশূন্য ঘোষণা করা  হচ্ছে যেখানে অল্প পুঁজি খরচ করে প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনা সম্ভব

দাতাদের চাপে এসব জায়গায় বিদেশী প্রজাতির গাছ দিয়ে এমন ধরনের বনায়ন যাতে এলাকার পরিবেশের  নাটকীয় পরিবর্তন এবং ক্ষতি হচ্ছে আজ শালবন এলাকার সর্বত্রই  বিদেশী প্রজাতির গাছের তৈরি করা কৃত্রিম বনবাগান  চোখে পড়ে ।

  এসব বাগানের ক্ষতিকর প্রভাব ইতিমধ্যেই আমরা জানতে শুরু করেছি শালবন এলাকায় বনবিনাশ নতুন কোনো  ঘটনা নয় বিশেষ করে বন বিভাগ তৈরি হবার পর থেকে ।

 কিন্তু রাবার মনোকালচার এ আগ্রাসী  প্রজাতিসম হ যেমন ইউক্যালিপটাস ও  আকাশিয়া দিয়ে বানিজ্যিকভাবে বন  তৈরি যখন থেকে শুরু তখন থেকে নজিরবিহীন বনবিনাশ শুরু হয়েছে ।  ১৯৮০-র দশকে মধুপুর শালবনে রাবার চাষ করতে গিয়ে হাজার জমির শালকপিস কেটে ফেলে বন বিভাগ।
এক্ষেত্রে রাবার চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক প্রমাণিত হয়নি, অন্যদিকে চাষ করতে গিয়ে যে হাজার হাজার একর মা জমি পরিষ্কার করা হয়েছে তার অনেক জায়গাতে এখন রাবার গাছ নেই । বন বিশেষজ্ঞরা এবং পরিবেশবাদীরা মধুপুরে রাবার চাষ না করে প্রাকৃ্তিক বন  ফিরিয়ে আনা অথবা মিশ্র বন গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন । 

রাবার চাষ করতে গিয়ে যে খরচ হয়েছে তার সামান্য একটা অংশ দিয়ে একাজ করা যেত ।
২০০৪ সালে এসে আমরা শুনছি মধুপুরের রাবার বাগান ব্যক্তি মালিকানায়  লিজ দিয়ে দেয়া হবে। কারণ সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাবার থেকে কাঙ্খিত  ফল পাওয়া যাচ্ছেনা । ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তরের ব্যপারটি রাজনৈতিক বটে, যারা লিজ পাবেন তারা হবেন বাইরের লোক এবং প্রভাবশালী  


এর ফলাচনা যে মারাত্মক হবে তা বলার  অপেক্ষা রাখে না। একদিকে পরিবেশের বিনাশ  অন্যদিকে এলাকাবাসীর বঞ্চনাএটাই মধুপুরে রাবার চাষের সার্বিক ফলাফল মধুপুরের সাত হাজার আটশ একর জমিতে রাবার চাষ সম্পন হবার পরপরই  এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় যে বানিজ্যিক জ্বালানি কাঠের ।

 প্লান্টেশন তৈরি হয় তার ফলে শালকপিস কাটা অব্যাহত থাকে । জ্বালানি কাঠ। উৎপাদন করতে যে আগ্রাসী প্রজাতিসমূহ দিয়ে প্লন্টেশন করা হয় তা মণ্ড  তৈরিতে বা কাগজ কলের কাঁচামাল হিসেবে বেশউপযোগী হতে পারে। পান্টেশনের কারণে মধুপুরের শালবনের অভাবনীয়  ক্ষতি হয়েছে। যেসব জায়গায় প্লান্টেশন হয়েছে এমন অনেক জায়গাই বর্তমানে বৃক্ষশূন্য । 

অথচ সামান্য বিনিয়োগে ও যত্নে এখানে এখন শালকপিস থাকতে পারত যা ক্রমান্বয়ে চমৎকার প্রাকৃতিক বন হয়ে যেত। বাণিজ্যিক বন শালবনের  প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে অধিকাংশ জায়গায়  

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post