সুন্দরবন বা প্যারাবন ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে লবণ পানির অনন্য। সুন্দরবন। সুন্দরবনের নাম এমন হবার একটি কারণ হয়তো এ বনের সর্বত্র সুন্দরী (হেরিটিরেরা ফোমস) গাছ । সুন্দরী গাছ খুবই শক্ত এবং মূল্যবান। তবে
সুন্দরবনের নামের ইতিকথা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সুন্দরবনের অধিকাংশ জোয়ারে তলিয়ে যায় আবার ভাটায় ভেসে ওঠে। জোয়ারের সময় হাজারো নদীনালা খালবিল দিয়ে সমুদ্রের পানি ধাবিত হয় উজানে। আবার ভাটায় পানি দ্রুত নেমে যায় সমুদ্রের দিকে । দিনে দুবার নয়ার ভাটার এমন নিসর্গ পৃথিবীতে বিরল । জোয়ার ভাটা সুন্দরবনের মাঝি-মাল্লা, জেলে, বন বিভাগের কর্মচারী এবং প্রাণী কূল সবার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। সবমিলে
সুন্দরবন হৃদয় কাঁপানো প্রকৃতির স্বপ্নপুরী পৃথিবীতে যার তুলনা বিরল ।
সংরক্ষিত বন সুন্দরবনের যে বৈশিষ্ট্য এ
বনকে এশিয়া, আফ্রিকা এবং
ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য প্যারাবন থেকে আলাদা রূপ দিয়েছে তাহলো বনসম্পদ ও মৎস্য সম্পদের একটি অন্যতম উৎস । স্থানীয় এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য এ বন খুব গুরুত্বপূর্ণ । আশির দশকে টিম্বার ও জ্বালানি কাঠের চাহিদা ৪৫ শতাংশের সরবরাহ এসেছে সুন্দরবন থেকে
(হুসেন এবং আচার্য। ১৯৯৪:১)।
চালু
অবস্থায় খুলনা নিউজপ্রিন্ট কাচামালের জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল ছিল। ডব্লিউ ডরিউ হান্টার সুন্দরী গাছসহ ৩০টি প্র ধান গাছের একটি
তালিকা দিয়েছেন। এর
মধ্যে কতকগুলো হলো বাইন, আমুর, বালাই, ভারা, বনজাম, হাবুর, গরান, গেওয়া, কনকর, পশুর, হেন্তাল, কনক্রি, কেনকতি, খালসি, কির পা,
সিংরা এবং সোন্দাল (হান্টার ১৯৯৮:
২২-২৬)। সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন গাছের প্রাধান্য দেখা যায়। পৃথিবীর অন্য কোনো প্যারাবন বা গরানবনে বসে ভাবাই যায় না যে বাংলাদেশের সুন্দরবনে এতো প্রজাতির গাছ এতোবড় হয় কী
করে । সুন্দরবনের এসব গাছ যেমন উঁচুলম্বা তেমন মজবুত। সুন্দরবন এলাকার সর্বত্র প্রধানত সুন্দরী ও অন্যান্য শক্ত কাঠের নৌকা স্থানীয় মানুষের একটি বড় অবলম্বন। সুন্দরবনের গোল পাতা, শন, ঘরবাড়ি তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। মধু,
মোমের কাচামাল, শামুক, চিংড়ি, কাঁকড়া এসব তো সুন্দরবন থেকে সব সময় হাজারো মানুষ
সংগ্রহ করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছে । সুন্দরবন এলাকা থেকে ১২০ প্রজাতির অধিক। মাছ ধরা পড়ে। সাম্প্রতিককালে চিংড়ির পো না সংগ্রহ সুন্দরবন এলাকায় । একটি বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড । সুন্দরবন ও
উপকূলীয় প্রাণ-বৈচিত্র্যের উপর নির্বিচারে চিংড়ির পোনা ধরার বিরূপ প্রভাবের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ। সরকার ২০০০ সালের ২১
সেপ্টেম্বর তারিখে এসআরও নং ২৮৯/আইন/ ২০০০-এর মাধ্যমে
“বাংলাদেশের উপকূলীয় জলসীমা ও মোহনায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে চিংডিপোনা, মৎস্যপোনা ও
অন্যান্য প্রজাতির যেকোনো বয়সের মৎস্যপোনা আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু এ আইন অকার্যকর।
পোনা ধরার মৌসুমে হাজার হাজার নরনারী দিনরাত চিংডিপোনা ধরছে ।
বিশাল এক জনগো ষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের এসকাপের (ESCAP) এক জরিপ অনুসারে পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ মানুষ সরাসরি তাদের জীবিকার জন্য বনের উপর নির্ভরশীল । এর মধ্যে বনসম্পদ নির্ভর বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহও রয়েছে । সুন্দরবন যে দৃশ্যত অর্থনৈতিক লাভের গুরুত্ব পূর্ণ উৎস তাই নয়,
উপকূলীয় ভূমিক্ষয় এবং
ঝড়ঝাপ্টা থেকে উপকূলীয় মানুষ ও তার সম্পদকে রক্ষা করা একটি বড় ঢাল ও
বটে।
বিশালতায়, উৎপাদশীলতায় এবং স্থানীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এর ঐতিহ্য ও
গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের গোটা উপকূল জুড়েই টুকরো টুকরো লবণ পানির বন
চোখে পড়ে। তবে সুন্দরবন বলতে আমরা যা বুঝি তা এক জায়গায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্যারাবন । এক জায়গায় দ্বিতীয় বৃহত্তম প্যারাবন মালয়েশিয়াতে যা সুন্দরবনের এক
দশমাংশ । ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার ১৮৭৩ সালে সুন্দরবনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে এর
সীমানা এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি চিত্র পাওয়া যায়। “উপকূলের বিশাল এলাকা জুড়ে। সুন্দরবন, হুগলি থেকে মেঘনা,
১৬৫ মাইল জুড়ে এর বিস্তৃতি; উত্তর দক্ষিণে। এর বিস্ততি সর্বাধিক ৮১ মাইল”
(হান্টার ১৯৯৮:১)।
সুন্দরবনের উপর নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অহর্নিশি মানুষ সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণ করছে। সরকারও নানাভাবে সুন্দরবন থেকে আয় করছে। এবং ব্যবহার করছে এর
মাটি । সুন্দরবন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বসতি,
চাষাবাদ। মানুষের এতো চাপের মুখেও সুন্দরবন টিকে আছে।
সুন্দরবন দুই দেশের মধ্যে পড়েছে। প্রায় ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে এবং বাকী অংশ ভারতের পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ-পূর্বে। বাংলাদেশের সুন্দরবন পড়েছে বাগেরহাট, খুলনা ও
সাতক্ষীরা জেলাজুড়ে। বাংলাদেশ অংশে ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার সুন্দরবনের গোটাটাই সংরক্ষিত বন; এর মধ্যে ৪, ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি যার ৪,০৬৯ বর্গকিলোমিটার বৃক্ষ আচ্ছাদিত (ইউএনডিপি, ফাও, ১৯৯৭:৩)।
সুন্দরবনের ভেতরকার দৃশ্য যেমন মনোরম তেমনি এর প্রাণীকূল বিশেষ। করে মাটিতে বাঘ ও পানিতে কামট-কুমির যে কারো মনে ভীতির সঞ্চার করে । শত শত নদীনালা,
খাল এবং জলাবদ্ধ অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা। চারিদিকে মাকড়শার জালের মতো এমন প্রাকৃতিক বন্ধন সৃষ্টি করে রেখেছে । যে এর
ভেতরকার দৃশ্য মনোরম ও ভীতিকর । সুন্দরবনে যখন রাত্রি নামে তখন। এর চেহারা যায় আরো পাল্টে । এদিক ওদিক যাবার উপায়টি নেই। বাইরে থেকে যারা সুন্দরবনে দুচার রাত্রির জন্য বেড়াতে যান সারা জীবন মনে থাকে তাদের সুন্দরবন ভ্রমনের কথা। সুন্দরবনের বড় বৈশিষ্ট্য হলো শত শত বছর ধরে মানুষ এর
অফুরন্ত সম্পদ আহরণ করলেও এখনো মথুরা জলের এই বনভূমি টিকে আছে।
প্রাণবৈচিত্র্য
এবং প্রাণী সম্পদে সুন্দরবন নজীরবিহীন। সবিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার
(Panther tigris tigris) সুন্দরবনের সমার্থক । সুন্দর বনের মানুষখেকো এ বাঘের সর্বশেষ প্রাকৃতিক আবাসস্থল। তাছাড়া
“সুন্দরবন এ অঞ্চলের বহু প্রাণী,
পাখি, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীর সর্বশেষ আবাস্থল
” (হুসেন এবং আচার্য ১৯৯৪:৮)। কিছু প্রাণী,
(অন্তত চারটি) যেমন জাভান রিনোসর্স (Rhineceros Sondaicus), বুনো মহিষ (Babalu.. bubalis), সোয়াম্প ডীয়ার (Cervus duvaceli) এবং হগ ডিয়ার (Axis porcinus) বিলীন হয়ে যাবার রিপোর্ট পাই আমরা । সুন্দরবনের প্রাণীজগতের অনেক প্রজাতিই আজ নানারকম হুমকির মুখে। বেআইনিভাবে নির্বিচার বাঘ ও
হরিণ শিকার, বৃক্ষ নিধন,
অবৈজ্ঞানিকভাবে
অন্যান্য সম্পদ আহরণ আমাদের এ জাতীয় ঐতিহ্যকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলেছে । একে বাচাবার জন্য নানা প্রকল্প, পরিকল্পনা ও
নীতি হচ্ছে বটে কিন্তু সে
সবের যথাযথ প্রয়োগ নেই । ফলে সুন্দরবনের উপর মানুষের নানামুখী আক্রমণ ও
অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে।
জোয়ারভাটার এ সুন্দরবন দেশের সবচাইতে বড় বনও বটে । এ বনের অধিকাংশ ১৮৭৫-৭৬ সালে “সংরক্ষিত বন
ঘোষণা করা হয়; লবণ পানি ও মিঠা পানির এক জটিল পরিবেশে এ বন টিকে থাকে । গঙ্গা ও দেশের অভ্যন্তর থেকে
প্রচুর পলিমিশ্রিত মিঠাপানি এ বনের গাছপালার জন্য পুষ্টি নিয়ে আসে।সুন্দরবনের পানিতে লবণাক্ততা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে । সুন্দরবনে গাছের আগা মরা রোগ দেখে মানুষ উদ্বিগ্ন এবং অনেকের ধারণা পানিতে। লবণাক্ততা বেড়ে যাবার জন্যই হয়তো বা
এ সর্বনাশা রোগের প্রাদুর্ভাব । বিশেষজ্ঞদের ধারণা নানা কারণে লবণাক্ততা বেড়েছে। প্রথমত গঙ্গা বা পদ্মার প্রধান ধারা ক্রমাগতভাবে পূর্বদিকে সরে যাওয়ায় এ
নদীর শাখা প্রশাখা দিয়ে প্রবাহিত মিঠাপানির পরিমাণ কমে গেছে । ভারতে গঙ্গানদীর উপরে তৈরি ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবনের মধ্যে মিঠা পানির প্রবাহ আরো কমে গেছে । যার ফলে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে । সুন্দরবন এলাকায় উপকূল ঘেষে।
কেউ যদি পূব থেকে পশ্চিমে যেতে থাকেন তবে লক্ষ করবেন যত পশ্চিমে যাবেন লবণাক্ততা তত
বেশি। কারণ পশ্চিমের দিকে উপর থেকে আসা মিঠাপানির প্রবাহ কম। সঙ্গত কারণে বর্ষামৌসুমে সুন্দরবন এলাকায় মিঠাপানির প্রবাহ বেশি। এসময় প্রচুর বষ্টিপাত হয় এবং গঙ্গা ও তার শাখাপ্রশাখা দিয়ে। প্রচুর মিঠাপানি প্রবাহিত হয়। সুন্দরবন এলাকায় পানিতে লবণাক্ততার যে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে ধারণা করা হয় পশ্চিমের দিকে লবণাক্ততা ভবিষ্যতে আরো বেড়ে যাবে। সুন্দরবনে গাছের আগামরা রোগের একটি কারণ হতে পারে পানিতে লবণাক্ততার বৃদ্ধি , তবে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু আগামরা রোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকেই আবার দেখছেন সুন্দরবনের বৃক্ষ ও অন্যান্য উদ্ভিদ সম্পদের। মাত্রাতিরিক্ত আহরণ,
বন বিভাগের দুনীতি এবং বন-দস্যুদের ক্রিয়াকলাপ যার ফলে সুন্দরবনের বনসম্পদ আশংকাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে । উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের যে স্বাভাবিক বন্ধন তা বিনষ্ট হচ্ছে। বন-জঙ্গলের বৈশিষ্ট্য এমন যে একটি গাছের বাঁচামরা তার আশেপাশের উদ্ভিদ জগতের
স্বাভাবিক বেচে থাকার উপর অনেক সময় নির্ভর করে। কাজেই নির্বিচার বৃক্ষনিধন ও
মানুষের আরো নানা ধরনের অত্যাচার ও
যে আগামরা রোগের একটি কারণ হতে পারে সে
সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া যায় না।
ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এসিস্ট্যান্স-এর এক
জরিপ অনুসারে (১৯৮৩-৮৪) সুন্দরবনের দুটো প্রধান বাণিজ্যিক প্রজাতির বৃক্ষ ১৯৫৭ এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০
শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সুন্দরবন এবং এর ( এখানে উল্লেখ্য যে সুন্দরবনে হরিণের পাল, বাঘ ও
মানুষের সহজ শিকার) জীবজগৎ বঙ্গপোসাগারের ঝড়-জলোচ্ছাসেও মাঝে মধ্যে লন্ডভন্ড হয়ে যায় । সুন্দরবন তিনটি ইকোলজিক্যাল অঞ্চলে বিভক্ত (ক) ওলিগোহ্যালাইন এখানে লবণাক্ততার মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ৫০০ থেকে ৫,০০০ মাইক্রোগ্রাম(mg) (খ) মেসোহ্যালাইন
—লবণাক্ততার মাত্রা প্রতি লিটারে ৫০০০
থেকে ১৫,০০০ মাইক্রোগ্রাম এবং
(গ) পলি হ্যালাইন-লবণাক্ততার মাত্রা
প্রতি লিটারে
১৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ মাইক্রোগ্রাম
। বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুযায়ী সুন্দরবনের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে । পানিতে লবণাক্তার মাত্রা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে সুন্দরবনের পরিবেশে বিশেষ করে উদ্ভিদ ও জীবজগতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে পারে এমন অনুমান করে অনেকে।
সুন্দরবনের বাইরে উপকূল বরাবর নানা জায়গায় বিক্ষিপ্ত বিপন্ন গরানবন
বা প্যারাবন দেখি আমরা । অনেক দ্বীপে লাগানো গরানবন গড়ে উঠেছে । লাগানো গরান বনে প্রজাতি বৈচিত্র্য কম হলেও এসবের গুরুত কম নয় । তবে উপকূল বরাবর এসব গরান বন চিংড়িচাষের কারণে আজ মারাত্নক হুমকীর মুখে। বিশেষ করে কক্সবাজার,
চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এসব
জেলায় বিস্তির্ন এলাকার গরানবন কেটে চিংড়িচাষ হচ্ছে। চিংড়ি চাষ ও
চিংড়ির পোনা শিকার
সুন্দরবনের জন্যও মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করেছে। অনেক জায়গায় প্রকৃতিক বন কেটেই কেবল চিংড়িচাষ হচ্ছে না, তৈরি করা বন কেটে ও
চিংড়িচাষ চলছে।
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content