বাংলাদেশের বাহারী মাছ।

মৎস্য প্রজাতির বৈচিত্র। পৃথিবীর মােট আয়তনের তিন ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল । এই বিশাল জলরাশিতে আকার-আকৃতিতে, ওজনে, জীবনচক্রে, দৈহিক গঠন এবং রঙ্গে বৈচিত্রপূর্ণ মাছ বসবাস করে। মাছ হচ্ছে পৃথিবীর সমুদয় মেরুদন্ডী প্রাণির অর্ধেক। পৃথিবীর মহাসাগর, সাগর, মােহনা, হ্রদ, নদী, হাওড়, বাওড়, খাল-বিল ও পুকুরে এখন পর্যন্ত ৩১,৬০০ প্রজাতির টেলিয়ষ্ট মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। মাছ প্রায় সব ধরণের জলাশয় যেমন গরম পানির ঝর্ণা যেখানে পানির তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর বেশী সেখানেও বসবাস করে (Sarotherodon grahami পূর্ব আফ্রিকার লেক মাগাদিতে পাওয়া যায়)। আবার উত্তর মেরুর সাইবেরিয়া ও আলাস্কার বরফের নীচের পানিতে যেখানে পানির তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস।

 এর নীচে সেখানেও মাছ বসবাস করে (আলাস্কা ব্র্যাকফিশ, Dalia pectoralis)।কিছু মাছ যেমন: মাড় মিনু (Umbra limi) ও ইয়েলাে পার্চ (Perca flavescens) খুব। কম পিএইচ (৩.২-৪.১) ও অক্সিজেন (১-২ পিপিএম) সম্পন্ন পানিতে বৃদ্ধি প্রাপ্ত ও বংশ বৃদ্ধি করতে পারে । ডিম পাড়া ও বাচ্চা দেয়া উভয় প্রকারের মাছ পাওয়া যায়। বেশিরভাগ মাছ ডিম পাড়ে কিন্তু অনেক মাছের প্রজাতি সম্পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বাচ্চা প্রসব করে। যদিও যেসব মাছ ডিম পাড়ে বা বাচ্চা দেয় সবাই ডিম উৎপন্ন করে থাকে। পার্থক্য শুধু এই ডিম উৎপন্ন করার পর ডিমের পরিস্ফুটন কোথায় হবে। বাচ্চা বহনকারী মাছের ডিম আভ্যন্তরিণ পরিস্ফুটন হয় । ডিম পাড়া মাছের ডিমের পরিস্ফুটন বাহিরের পরিবেশে হয়ে থাকে। মাছের উলম্ব বিস্তারে সমুদ্র সমতল হতে ৫ কিলােমিটার উর্দ্ধে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে । ১১ কিলােমিটার গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত । মাছ ৫ কিমি. উচ্চতায় অবস্থিত পাহাড়ি লেকে (যেমন: Schizothorax plagiostomuS), ১১ কিমি. গভীর প্রশান্ত। মহাসাগরের মেরিয়ানা ট্রেঞ্চ নামক গভীর খাদে (যেমন: AteleopuS japonicus), বদ্ধ জলাশয়ে (যেমন: Cyprinus Carpio), দ্রুত প্রবাহমান নদীতে (যেমন: Tor tor), পাহাড়ি ঝর্ণায় (যেমন: Danio dangila), বরফ-গলা নদীতে (যেমন: Schizothorax richardsonii), এমনকি মহাসাগরের গভীর খাদ (যেমন: মেরিয়ানা ট্রেঞ্চ), যেখানে কোন আলাে নাই সেখানেও বসবাস করে।

বাংলাদেশের মিঠাপানি যেমন নদী, হাওড়, বাওড়, খাল, বিল ও পরে, প্রজাতির এবং সাগর ও মােহনায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে । এই বিশাল গত ভান্ডারের মাঝে রয়েছে অনেক প্রজাতির বাহারী মাছ (ornamental tick বাংলাদেশে প্রাপ্ত ৬৬ প্রজাতির মাছ একুইরিয়াম মাছ হিসাবে ব্যবহৃত হয় (সারত ১)। মিঠাপানির বাহারী মাছ যেমন: পৃষ্ঠদেশ সবুজাভ ধূসর ও বক্ষদেশ সাদা বর্ণের কাকিলা মাছ (Freshwater Niddle Fish: Xenentodon cancila), শরীরের উর্ধাংশ সবুজাভ, নিমাংশ সাদাটে, পাখনা হলুদাভ ও কমলা রঙের মার্জিন fetare PNC9 975 (Blue Panchax: Aplocheilus panchax), Tere সবুজাভ ও নিম্নাংশ সাদাটে শরীর বিশিষ্ট বেচি কানপােনা (Green Panchay. Oryzia melastigma), পিঠের দিকে বাদামি নিচের দিক ক্রমশ হালকা ও গায়ে। ৮-৯ টি খাড়া কালাে দাগ বিশিষ্ট টাকি মাছ (Spotted Snakehead: Channa punctatus), দেহের উপরের দিক জলপাই সবুজ, চোখ থেকে লেজ পর্যন্ত মধ্য।

শরীর বরাবর কালাে দাগ, নিমাংশ হলুদাভ সাদা শরীর বিশিষ্ট দারকিনা (Flying _ barb: Esomus danricus), গায়ের রং হালকা বাদামি ও নিচের দিকে রূপালি বর্ণের মাছ জয়া (Jaya: Aspidoparia jaya), দেহের উপরের দিকের রং ইষৎ বাদামি, নিমভাগ রূপালি ও পাশে খাড়া ২-৩ সারি নীল দাগ বিশিষ্ট পাহাড়ি নদীর নুড়িযুক্ত তলদেশে প্রাপ্ত পাথরচাটা/তিলা কোকশা মাছ (Tileo Baril: Barilius tileo), দেহের উপরের দিকের রং হালকা সাদা, নিম্নভাগ রূপালি ও পাশে খাড়া ১১-১৬ সারি নীল দাগ বিশিষ্ট শরীর পাহাড়ি নদীর নুড়িযুক্ত তলদেশে প্রাপ্ত বৈরালি/কোকশা মাছ (Baril: Barilius barila), উপরের দিকটা সবুজাভ ও নিচের দিকটা রূপালী এবং পিছনের দিকে নীল ও হালকা কমলা রঙের লম্বা ডােরা বিশিষ্ট | দিবারি/ছেবলি মাছ (Sind Danio: Danio devario), শরীরে চারটি লম্বালম্বি ধাতব নীল ডােরা/ব্যান্ড ও ৩টি সরু রূপালি ডােরা বিশিষ্ট আঞ্জু (Anju: Brachydanio rerio), সবুজাভ রূপালী শরীর, রূপালী সাদা পেট ও ২টি খাড়া। ডােরা বিশিষ্ট ফুটানি পুঁটি (Spotted barb: Puntius phutunio), পৃষ্ঠ উজ্জ্বল জলপাই সবুজ, পার্শ্ব ও উদর লাল আভাযুক্ত রূপালী এবং লেজের সম্মুখে কালাে। বড় দাগ বিশিষ্ট কাঞ্চন পুঁটি (Rosy barb: Puntius Conchonius), দেহ রূপালী ও পার্শ্বরেখা অঙ্গে ২টি কালাে দাগ বিশিষ্ট তিত পুঁটি (Ticto barb: Puntius ticto), দেহ লালাচে বাদামি, পুচ্ছ পাখনা থেকে একটু দূরে লেজে ১টি কালাে। ডােরা এবং পায়ু ও পৃষ্ঠ পাখনার সম্মুখ ভাগে কালাে দাগ বিশিষ্ট গিলি পুটি Golden barb: Puntius gelius), পৃষ্ঠ ধাতব সবুজ, পার্শ্ব সবুজাভ রূপালি । রচের দিক হালকা লালচে বা বেগুনি আভাযুক্ত, পুচ্ছ পাখনা বরাবর একটি বাতিল

দাগ এবং কানকোয়ার অব্যহিত পরেই আরাে একটি কালাে দাগ বিশিষ্ট উরি পঁটি (Onespot barb: Puntius terio), দেহের উপরিভাগ হালকা বাদামী। নিচের দিক ইষৎ হলদে, পাশ্ব ও পৃষ্ঠে কয়েকটি বাদামী ডােরা এবং পুচ্ছ পাখনায়। দাগ বিশিষ্ট পাহাড়ি গুতুম (Gongota loach: Somileptes gongota), ঐবে ৭-৮ টি খাড়া গাঢ় বাদামী, প্রতিটি বাদামি ডােরার পাশে ১টি হলদে ডােরা সে পচ্ছ পাখনায় ২-৩ টি বা অধিক ডােরা/ব্যান্ড বিশিষ্ট রাণী মাছ (Bengal loach: Botia dario), হলুদাভ শরীর, ধুসর বর্ণের আড়াআড়ি ৬-৭টি ডােরা। বিশিষ্ট বেটি মাছ (Reticulate loach: Botia lohachata), পৃষ্ট গাঢ় বাদামী, নিচের দিক হলুদাভ, হালকা কালাে ডােরা পুচ্ছ পাখনার গােড়া পর্যন্ত বিস্তৃত এবং উপরে নিচে সারিবদ্ধ অনেক দাগ বিশিষ্ট গুতুম মাছ (Guntea loach: Lepidocephalus guntea), পৃষ্ঠ হালকা বাদামী, পার্শ্বদেশ রূপালী, নিচের দিক সাদাটে এবং পার্শ্ব রেখা বরাবর ৯-১০টি অনিয়মিত বাদামী দাগ ও লেজের গােড়ার। ১টি গাঢ় কালাে ফোটা বিশিষ্ট পুঁইয়া মাছ (Annandale loach; Lepidocephalus annandalei), উর্ধাংশ ধূসর ও নিমাংশ হলুদাভ সাদা এবং পার্শ্ব রেখা বরাবর নীলাভ বর্ণের দাগ বিশিষ্ট কাবাসী/গুলশা টেংরা (Gangetic mystus: Mystus cavasius), গায়ের রং সবুজ থেকে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের। শরীরসহ কাঁধে ১টি গভীর কালাে দাগ এবং গায়ে গাঢ় বাদামী রঙের লম্বালম্বি ৪৫টি ডােরা বিশিষ্ট বুজুরী টেংরা (Striped Dwarf Catfish: Mystus tengara), উর্ধাংশ সবুজাভ/ধূসর বাদামি ও নিমাংশ হলুদাভ,পার্শ্ব রেখার উপর বরাবর ১টি উজ্জ্বল ডােরা এবং ৩-৯ টি কালাে ফোটা বিশিষ্ট তারা বাইম (Lesser Spiny Eel: | Macrognathus aculeatus), পৃষ্ঠ ও পার্শ্ব গাঢ় বাদামী রঙের এবং নিমাংশ । হলুদাভ শরীর বিশিষ্ট শাল বাইম (Zig zag Eel: Mastacembelus armatus), শরীরের উর্ধাংশ ইষৎ সবুজ-বাদামি ও নিমাংশ ময়লা সাদা বিশিষ্ট খলিশা মাছ। (Banded Gourami: Colosa fasciatus), দেহ লালচে, ফ্যাকাশে নীল রঙের। আড়াআড়ি তীর্যক ডােরা ও পাখনায় লালচে দাগ বিশিষ্ট লাল খলিশা (Dwarf Gourami: Colisa lalius), গায়ে বাদামি-কালাে রং ও চোখ থেকে পুচ্ছ পাখনার । গােড়া পর্যন্ত রূপালী-সাদা দাগ বিশিষ্ট নাপিত/নাপতানি/মধুমালা/বেউকুল মাছ । (Frail Gourami: Ctenops nobilis), গায়ের রং ইষৎ সবুজ-বাদামি, ৩টি খাড়া কালচে ডােরা দাগ ও পাখনায় সরু ডােরা বিশিষ্ট মেনি/ভেদা মাছ (Mud Perch: Nandus nandus), গায়ের রং কালচে অথবা গাঢ় বাদামি এবং পুচ্ছ। পাখনা ও কানকোয়ার গােড়ায় ১টি করে কালচে নীল ফোটা বিশিষ্ট নাপিত কই কই। বান্দি (Badis: Badis badis), দেহ কমলা হলুদ, তিনটি খাড়া কালচে দাগ এবং লালচে রঙের পৃষ্ঠ, শ্রেণী, পায়ু ও পুচ্ছ পাখনা বিশিষ্ট লাল চান্দা (Highfin Glassy Perchlet: Parambassis lala) ইত্যাদিসহ আরাে অনেক মাছ বাহারী মাছ হিসেবে পরিচিত।


আমদানিকৃত বাহারী মাছ। একুইরিয়াম ফিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্য দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ১৬টি পরিবারের ৫৭টি গণের ৯৩টি প্রজাতির বাহারী মাছ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। যদিও একুইরিয়াম ফিশের ব্যবসা বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত নয় এবং এই সমস্ত মাছ আমদানির সময় কোন কোয়ারেনটাইন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় নাই। একুইরিয়াম ফিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্য Loricariidae ফ্যামিলির সাউথ আমেরিকান সাকার মাউথ ক্যাটফিশ Hypostomus punctatus বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তিতে জনৈক বিদেশী একুইরিয়াম থেকে গুলশান লেকে তা ছেড়ে দেয়, ফলস্বরূপ আজ সারা বাংলাদেশের পুকুর ও খালে সাকার মাউথ ক্যাটফিশ বিস্তৃতি লাভ করেছে । Poeciliidae ফ্যামিলির ৫টি প্রজাতির বিদেশী বাহারী মাছ একুইরিয়ামে ব্যবহারের জন্য আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছে । Poeciliidae ফ্যামিলির মাছ বাচ্চা দেয়। উত্তর আমেরিকা থেকে আনা হয়েছে ১টি প্রজাতি নাম গাপ্পি, Poecilia reticulata এবং মধ্য আমেরিকা থেকে ৪টি প্রজাতি যেমন: ব্ল্যাক মােলি (Poecilia sphenops), সেইলফিন মােলি (Poecilia velifera), Go Go 29 (Xiphophorus helleri) e Cargo (Xiphophorus maculatus)। এই সব প্রজাতির মাছ আকারে খুব ছােট প্রায়। ১-২ ইঞ্চি সাইজের হয়ে থাকে এরা লার্ভিভাের (Larbivore), মশার লার্ভি খেয়ে | মশা নিয়ন্ত্রণ করে গােল্ডফিশ (Carassius auratus) চীন থেকে আমদানি করা। একটি বাহারী মাছ, যার লাল লেজ একুইরিয়ামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। গােল্ড ফিশ বর্তমানে আমাদের দেশে খুব জনপ্রিয় একুইরিয়াম মাছ। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন খামারী এই মাছের চাষ ও পােনা উৎপাদনের কাজে নিয়ােজিত। | একুইরিয়ামে বাহারী মাছ হিসাবে ব্যবহারের জন্য Cyprinidae পরিবারের মােট ১৭ প্রজাতির মাছ আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছে।

মৎস্য সম্পদ। অপর দিকে ইউরােপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় স্পোর্টস ফিসিং হিসেবে  আভ্যন্তরিণ মৎস্যসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে একুইরিয়ামে ব্যবহৃত  মাছসমূহ প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ধরা হয়। কিছু কিছু প্রজাতি মাছের কেত্রিম  প্রজনন কৌশলও উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রজাতি, আকার, রং ভেদে মূল্য নির্ধারিত  হয় । দেশি প্রজাতির প্রতিটি মাছের মূল্য সাধারণত ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু বিদেশী অনেক মাছের মূল্য ৫০০ থেকে ২০০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ঢাকার কাটাবন, টঙ্গি, চট্টগ্রামের এ কিল্লা, খুলনার খালিশপুর, যশােরের চাচড়া, ফেনীর মহিপাল এ ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বাণিজ্যিকভাবে একুইরিয়াম মাছের উৎপাদন, চাষ বিপনন করা হয়ে থাকে। এদেশে বাহারী মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মাছের কিত্রিম  প্রজননের মাধ্যমে পােনা উৎপাদন করে এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব । আন্তর্জাতিক বাজারে বাহারী মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করাও জরুরী । বর্তমানে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া, লাওস, তাইওয়ান, চীন, জাপান, কেরিয়া, ভারত ও শ্রীলংকা আন্তর্জাতিক বাজারে বাহারী মাছ রপ্তানি করে থাকে ।  দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, বলিভিয়া, চিলি, জামাইকা, আর্জেন্টিনা ইত্যাদি দেশ ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাহারী মাছ রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশের রংবেরং এর বহরী মাছ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে বৈদিশেক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব ।

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post