উৎপত্তি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

গারােদের উৎপত্তি এবং তাদের আদিনিবাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করা প্রায় এক অসম্ভব ব্যাপার। কারণ এই কাজের জন্য কোন লিখিত তথ্য কিংবা ধারাবাহিক কোন প্রমাণ নির্ভর ইতিহাস পাওয়া যায় না। অপরদিকে গারাে সমাজে বংশ পরম্পরায় যে সব লােককাহিনী চালু রয়েছে সেগুলাে তাদের উৎপত্তি এবং আদিনিবাস নির্ণয়ের কাজে তেমন মুল্যবান তথ্য যােগায় না, কারণ সেগুলাের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে এই উপমহাদেশে তাদের স্থায়ী বসতিস্থাপনের পরবর্তীকালে। 


কাজেই গারােদের উৎপত্তি এবং তাদের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা নিতে হলে প্রধানতঃ ন-বিজ্ঞানী ও ভাষা বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর নির্ভর করাই যুক্তিযুক্ত। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে গারােরা প্যালিও মংগােলীয় শ্রেণীভূক্ত তিব্বতী বর্মণ জনগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের আদিনিবাস বর্তমান চীনের উত্তর পশ্চিম এলাকায় সিন-কিয়াং প্রদেশে। পরবর্তীকালে প্রতিকূল আবহাওয়া এবং পরিবেশগত কারণে। তারা তাদের আদিনিবাস পরিত্যাগ করে তিব্বতের উত্তরাঞ্চলে বসতিস্থাপন করে। তিব্বতের এই অঞ্চলে তারা বহু শতাব্দীকাল বসবাস করে। পরে এই অঞ্চল হতেও তারা প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ এবং সেই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশ ত্যাগ করে সাউইন, চিন্দুইন, মেনাম, সংদু (সানপাে) প্রভৃতি নদ-নদীর গতিপথ অনুসরণ করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করে। এই অঞ্চলটিই বর্তমানে নানা আদিবাসী জনগােষ্ঠী দ্বারা অধ্যুষিত। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরতঃ বােড়াে জনগােষ্ঠীর অন্যান্য শাখার লােকজন যেমন, কাছাড়, মেচ, রাভা, মিকির, কোচ, নাগা, মিসূমি, ত্রিপুরা প্রভৃতি আদিবাসী জনগােষ্ঠীর সঙ্গে গারােদের নানা দিক দিয়ে সাদৃশ্য বিদ্যমান। কাজেই এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় তিব্বতে বসবাস পর্যন্ত গারােসহ প্রাগুক্ত অন্যান্য আদিবাসীগণ একই দলভূক্ত ছিল এবং তিব্বত ত্যাগের সময়েই তারা বিভিন্ন দলে। বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পথে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। গারাে লােককাহিনী মতে গারােদের আদি পুরুষের দলটি জাপা-জালিনা এবং সুখফা-বােংগিফা নামক নেতৃদ্বয়ের নেতৃতে তিব্বত হতে হিমালয়ের দুর্গম গিরিপথ অনুসরণ করে ভূটান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে এবং এ দেশে তারা প্রথমে বর্তমানের কোচবিহারকে তাদের বাসভূমি হিসেবে নির্বাচন করে। এই কোচবিহারে তারা দীর্ঘ চার শতাব্দীকাল বসবাস করে এবং নানাদিক দিয়ে যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করে। পরে সেখানকার রাজার নানারূপ সন্দেহ ও শত্রতা সেই দেশ ত্যাগ করে। সদলবলে ব্ৰহ্মপুত্র নদের উত্তর তীর বরাবর পূর্ব দিকে পদযাত্রা শুরু করে এবং শেষাবধি বর্তমান আসামের কামরূপ-কামাখ্যা এলাকায় উপনিবেশ গড়ে তােলে।

পদ্যাত্রাকালে তাদেরকে নানা প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয় । আসামের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নৃৃপতি তাদেরকে আক্রমন চালায়। অবশেষে আসামের মধ্যাঞ্চলে বসবাসকালে সেখানকার নৃপতির বশ্যতা স্বীকার করে গারােদেরকে সেখানে বসবাস করতে হয়। মধ্য আসামে তাদের এই বসতিকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগের কথা। কারণ একদল গারাে যুবক কামরূপের রাজা ভগদত্তের সৈন্যরূপে তাঁর সঙ্গে কৌরবদের পক্ষে কুরুক্ষেত্রের ভ্রাতৃঘাতী মহাযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে এ কথা হিন্দুদের প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতে জানা যায় এবং কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ ইতিহাস ভিত্তিক। পন্ডিতগণের অভিমত, উহার সংঘটিতকাল খ্রিস্টজন্মের প্রায় সােয়া তিন হাজার বছর পূর্বে। মহাভারতের। প্রাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বলে স্বীকৃত । তিনি ততীয় পান্ডব মহাবীর। অর্জুনের রথের সারথী হিসাবে এই মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অতি সম্প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে গণনা করে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাল নির্ণয় করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গণনা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাল একুশে জুলাই তিন হাজার দুইশত আটাইশ খ্রিস্টপূবাদ যে তারিখটি সম্পর্কে শ্রীমদভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ, মহাভারত প্রভৃতিতে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তাঁর অন্যতমা মহিষী রুক্ষ্মিণী ছিলেন বর্তমান অরুনাচল প্রদেশের অধিবাসী মিসূমী আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মেয়ে আর তারই সূত্র ধরে নাতী অনিরুদ্ধের জন্য অপর এক মিসমী দলপতি বান রাজার কন্যা উষাকে তিনি নাতবৌ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মহাভারতেরই অন্যতম ব্যক্তিত্ব অর্জুন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তাঁর একাকী পরিভ্রমণকালে একজন আও দলভূক্ত নাগা মেয়ে উলুপীর পাণি গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে একজন মনিপুরী রাজকন্যা চিত্রাংগদার পাণি গ্রহণ করেছিলেন এটিও জানা যায় । আৰ্য বেদকারেরা এবং রামায়ন, মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্য ও পুরান প্রণেতাগণ গারাে, নাগা, মিসূমী প্রভৃতি আদিবাসী জনগােষ্ঠীকে কিরাত নামে। অভিহিত করেছেন এবং ঐসব আদিবাসী জনগােষ্ঠীগণ প্রাক-আর্য্যযুগেও ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছিল এটি। নিঃসন্দেহে বলা যায়। যা হােক রাষ্ট্রীয় গােলযােগহেত পরবর্তীকালে গারােরা মধ্য আসামের বাসস্থান পরিত্যাগ করে পুনরায় পশ্চিমাভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে এবং বর্তমানে গোয়ালপাড়া হাবরাঘাট এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এখানে আগমনকালেই গারোরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে । গারোদের একটি শক্তিশালী দল আব্রাসেন নামক দূর্ধর্ষ নেতার নেতৃত্বে হাবরাঘাটে একটি গারো রাজ্য স্থাপন করে এবং খুৰ সম্ভবতঃ সেটাই প্রথম গারো রাজ্য । সেখানে বসতি কালে গারোরা নানাদিক দিয়ে প্রভূত সমদ্ধি লাভ করে । বর্তমানে হাবরাঘাটে এখনো গারাে রাজধানীর কি কি ধবংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায় । এই হাবরাঘাট হতেই পরবর্তীকালে রাজা আবংনগা এবং তার স্ত্রী নেতৃত্বে একদল দুঃসাহসী গারাে বর্তমান গারাে পাহাড়ের তুরা শহরের অদুরে নকরেকে পাহাড়ের পাদদেশে আগমন করে ও সেখানে বসতি স্থাপন করে। এরাই গার পাহাড়ের প্রথম বাসিন্দা এবং এদের পরেই গারোরা পর্যায়ক্রমে গারাে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন এবং দলে পরিচিতি হতে থাকে । পরবর্তীতে ঐ সব দল ও গোত্রগুলোর মধ্যে প্রায়ই বিবাদ হানাহানি লেগে থাকতো । যার পরিণতিতে অপেক্ষাকৃ্ত সরল ও নিরীহ গারোরা গারো পারহাড়ের সানুদেশে সমতল ভূমিতে পলায়ন করে বসতি স্থাপন করে এবং এরাই বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী গারোদের পূর্ব পুরুষ ।

দৈহিক গঠন

শারীরিক উচ্চতার দিক দিয়ে গারোরা মধ্যম আকৃ্তির । দীর্ঘদেহী গারাে যেমন কম দেখা যায় তেমনি খর্বাকৃ্তি গারো খুব কমই দেখা যায় । অবশ্য পাহাড়ী গারোদের তুলনায় সমভূমির বিশেষতঃ বাংলাদেশের গারোরা বেশ দীর্ঘ দেহী কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে বাঙালিদের অবয়বে সাদৃশ্য লক্ষণীয় । গারো পাহাড়ের গারোরা তুলনামূলকভাবে খর্বাকৃতি, পায়ের গোছা বেশ পুরুষ্ট, মুখমন্ডল গালাকৃৃ্তি, চোয়াল সামান্য উচু এবং চোখ ছােট আকারের। নাকের গড়ন ও তাদের প্রায় চেপ্টা দেখা যায় ।এক কথায় মংগলীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিটি অবয়ব বৈশিষ্ট গারোদের মাঝে সুস্পষ্ট । সামগ্রিকভাবে গারােদের গায়ের রং মেটে পিতাভ এবং খুব বেশী ফর্সা কিংবা নিকষ কালো চেহারার গারো বেশী দেখা যায় না ।

তবে মেয়েদের গায়ের রঙ প্রায়ি ফর্সা দেখা যায় । গারো যুবতীরা বেশ সুঠাম দেহারে অধিকারিনী, তারা বেশ হাসিখুশী, উচ্ছল এক সহজ সরল স্বভাবের । অবশ্য গারো মেয়েদের যৌবনকালকে খুব বেশি দীর্ঘস্থায় বলা যায় না । কারণ বিয়ের পর একটি দুটি সন্তান জন্মদানের পরেই তারা কে হন নিজেদের সাস্থ্য ও রুপচর্চার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিক দেহ সৌষ্ঠব সংরক্ষনে ব্যথ হয় । অবশ্য বর্তমানে শিক্ষিত মহলে এর ব্যতিক্রমও সুস্পষ্ট।আধুনিক শিক্ষার আলােকপ্রাপ্তা গারাে মহিলারা রূপচর্চা এবং দেহসৌষ্ঠব সংরক্ষণে। যে কোন শিক্ষিত সমাজের মহিলাদের সমতুল্য। গারাে পাহাড়ের কোন কোন এলাকার বিশেষত সােমেশ নদের তীরবর্তী অঞ্চলগুলাের গারোরা দেখতে বেশ। সুঠাম, সুন্দর ও দাফকায় শারীরিক দিক দিয়ে গারােরা বেশ শক্তিশালী। মেদবহুল মােটা ভূড়িওয়ালা লােক গারাে সমাজে নেই বলা চলে এবং এর জন্য খুব সম্ভবত পার্বত্য আবহাওয়া ও পরিবেশে শারীরিক পরিশ্রম, চলাফেরা আর সেই সঙ্গে স্নেহজাতীয় খাদ্য দ্রব্যের প্রতি তাদের স্বাভাবিক অনীহা দায়ী বলে মনে হয়। গারােদের গড় আয়ু মােটামুটি স্বাভাবিক এবং শিশু মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম বয়ােবৃদ্ধ গারােরা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত মােটামুটি কর্মক্ষম থাকে। বৃদ্ধাবস্থায় পঙ্গু এবং চলৎশক্তি রহিত গারাে খুব কমই দেখা যায় ।


Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post