ওমিক্রন: করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে যা জানা গেছে
এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, হংকং, বেলজিয়াম ও ইসরায়েলে মাত্র কয়েক ডজন মানুষের দেহে ভাইরাসের এ নতুন ধরনটির সংক্রমণ ধরা পড়লেও এর জিন বিন্যাস ভয় দেখাচ্ছে।
এর জিন কাঠামো এত বেশিবার পরিবর্তিত (মিউটেট) হয়েছে যে আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ওমিক্রন অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এবং টিকাও এর বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন।
অবশ্য বিজ্ঞানীরা এটাও বলছেন, এ ভ্যারিয়েন্ট কতটা সংক্রামক বা এর আক্রমণের ধরন কতটা তীব্র হবে, টিকার সুরক্ষা এড়াতে পারবে কিনা কিংবা এর কারণে মহামারী পরিস্থিতির অবনতি হবে কিনা- এসব প্রশ্নের উত্তর অনুমানের ভিত্তিতে দেওয়া যাবে না।
সেজন্য আরও সময় দরকার, প্রয়োজন আরও পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ।
ফলে ওমিক্রন অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বজুড়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরন বা ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত করার কথা জানান গত মঙ্গলবার। যেসব নমুনা থেকে ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া গেছে সেগুলো নেওয়া হয়েছিল ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বরের মধ্যে।
বুধবার আরও পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে তারা ভ্যারিয়েন্টটি নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি সরকারকে জানান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাইরাস ইভোলিউশন বিষয়ক টেকনিকাল গ্রুপকে বসতে বলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ মানুষের দেহে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে, যার বেশিরভাগই মিলেছে সবচেয়ে জনবহুল গৌতেং প্রদেশে।
এর বাইরে বতসোয়ানা, হংকং, বেলজিয়াম ও ইসরায়েলে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে।
নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছে; ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
গবেষকরা করোনাভাইরাসের এই নতুন ভ্যারিয়েন্টকে চিহ্নিত করছেন বি.১.১.৫২৯ নামে। তবে আলোচনার সুবিধার জন্য শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দিয়েছে ‘ওমিক্রন’। একে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে আলফা, বেটা, গামা ও ডেল্টার ক্ষেত্রেও একই ভাষ্য ব্যবহার করেছিল তারা। এর অর্থ হচ্ছে- প্রাথমিক তথ্য প্রমাণে ভ্যারিয়েন্টটি বেশি সংক্রামক এবং এর বিরুদ্ধে টিকা কম কার্যকর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কতটা সংক্রামক
দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যালোচনায় ভ্যারিয়েন্টটি গৌতেংয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং সম্ভবত এখন দেশের অন্য ৮টি প্রদেশেও পৌঁছে গেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার দেশটিতে শনাক্ত রোগী মিলেছে ২ হাজার ৪৬৫ জন; এই সংখ্যা আগের দিনের প্রায় দ্বিগুণ।
দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজেস (এনআইসিডি) নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণেই এমনটা হয়েছে তা না বললেও দেশটির বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা রোগীর ঊর্ধ্বগতির পেছনে বি.১.১৫২৯ ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে।
এখন পর্যন্ত যাদের দেহে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে, তাদের বড় অংশই তরুণ।
তবে এটি টিকাদানের হার বেশি এমন এলাকায় কেমন আচরণ করবে, তা বলা যাচ্ছে না।
সবচেয়ে বেশি যে দেশে ভ্যারিয়েন্টটি মিলেছে, সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় টিকাদানের হার খুবই কম। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের এক চতুর্থাংশের সামান্য বেশি কোভিডের টিকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জো পাহলা।
উদ্বেগ কেন
উদ্বেগের কারণ এ ভাইরাসের জিন বিন্যাসে মিউটেশন বা রূপবদলের সংখ্যা।
কোয়াজুলু-নাটাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সিকোয়েন্সিং প্ল্যাটফর্মের পরিচালক তুলিও ডি অলিভিয়েরা বলছেন, নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের ‘মিউটেশনের ধারা খুবই অস্বাভাবিক’, যার মধ্যে ৩০ এরও বেশিবার মিউটেশন হয়েছে কেবল স্পাইক প্রোটিনেই।
সব ভাইরাসই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলায়। তবে বেশিরভাগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই ভাইরাসটি যে দেহে আশ্রয় নেয় তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না, বা ফেললেও তা এত সামান্য যে টেরই পাওয়া যায় না।
তবে কিছু কিছু পরিবর্তন ভাইরাসটি কত দ্রুত ছড়াতে পারে, তার আক্রমণের তীব্রতা কেমন হবে এবং টিকার কার্যকারিতা- এসব বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহের কোষে প্রবেশে ভাইরাস যে স্পাইক প্রোটিনকে ব্যবহার করে, বি.১.১.৫২৯ এর সেই স্পাইক প্রোটিনেই মিউটেশন হয়েছে ৩০ বারের বেশি, যা ডেল্টার মিউটেশনের প্রায় দ্বিগুণ এবং উহানে শনাক্ত হওয়া আদি ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে ‘উল্লেখযোগ্য পার্থক্য’ সৃষ্টি করেছে।
কোভিড মোকাবেলায় বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে তার সবগুলোই বানানো হয়েছে করোনাভাইরাসের আদি রূপকে ধরে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভ্যারিয়েন্টটির কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষের শরীরের অ্যান্টিবডিকে অকার্যকর এবং দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার সক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে অন্য অনেক পরিবর্তন সম্বন্ধে এখনও কিছুই জানা যায়নি, তাই এটি আদতেই কেমন আচরণ করতে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অন্য ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে পার্থক্য কতটা
ভ্যারিয়েন্টটি এখন পর্যন্ত পাওয়া অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় অনেক বেশিবার জিনের বিন্যাস বদলেছে; যাকে ‘ভয়ঙ্কর’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন এক বিজ্ঞানী, আরেকজন বলেছেন তারা এর চেয়ে খারাপ ভ্যারিয়েন্ট এখন পর্যন্ত দেখেননি।
বি.১.১.৫২৯ এ পাওয়া কয়েকটি মিউটেশন এর আগে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। সেসব মিউটেশনের ফলে ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত সংক্রমিত হতে পারবে বলে আন্দাজ করা হচ্ছে।
কিন্তু নতুন ভ্যারিয়েন্টে আরো কিছু মিউটেশন রয়েছে যার কারণে হয়তো শরীরের অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারবে না এবং ভ্যাকসিন অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর হবে, বলছেন বিজ্ঞানীরা।
"মিউটেশনগুলো ভাইরাসকে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শক্তিশালী করেছে বলে আশঙ্কা করছি আমরা। ইমিউন সিস্টেমের বিভিন্ন অংশকে পাশ কাটিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সক্ষমতাও থাকতে পারে এগুলোর," বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাটাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সিকোয়েন্সিং প্ল্যাটফর্মের রিচার্ড লেসেলস।
উদ্বেগ কি অহেতুক?
এর আগেও করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেসব আতঙ্ক কেবল কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল।
যেমন, এ বছরের শুরুতে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক তৈরি করেছিল বেটা ভ্যারিয়েন্ট, কেননা ইমিউন সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ছিল করোনাভাইরাসের এই ধরনটির। কিন্তু দ্রুত সংক্রমিত হওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কাছে এটি ধরা খেয়ে যায়।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবি গুপ্ত বলছেন: "বেটা কেবল ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিত, আর কিছু না। কিন্তু ডেল্টার ছিল বেশি সংক্রমণ ও ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দেওয়ার মাঝারি মাত্রার সক্ষমতা। নতুন ভ্যারিয়ন্টের দুই ধরণের ক্ষতি করার সামর্থ্যই উচ্চ মাত্রার থাকতে পারে।"
তবে এখন পর্যন্ত ওমিক্রন শনাক্ত হওয়াদের দেহে নতুন অস্বাভাবিক কোনো উপসর্গ পাওয়া যায়নি; আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মতো এটির ক্ষেত্রেও এমন অনেককেই পাওয়া গেছে যাদের কোনো উপসর্গই নেই, বলেছে দক্ষিণ আফ্রিকার এনআইসিডি।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরই মত, গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে আরো পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যাবে কিন্তু প্রকৃতিতে এই ভাইরাস কেমন আচরণ করে, তা পর্যবেক্ষণ করলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর খানিকটা আগে পাওয়া সম্ভব।
আমাদেরও সম্ভবত সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।
উদ্বেগ, আতঙ্ক থেকেই বিশ্বের অনেক দেশ এরই মধ্যে সতর্কতামূলক পদক্ষেপও নিয়ে নিয়েছে। কেননা মহামারীর শিক্ষাই হচ্ছে- সবসময় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলে আপনার চলবে না, আগেই পদক্ষেপ নিতে হবে, সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content