জুমচাষকত ক্ষতিকর
জুমচাষ বাংলাদেশের একটি প্রাচীন চাষ পদ্ধতি। বস্তুত জু মী আঞ্চলের সর্বত্রই একটি প্রাচীন চাষ পদ্ধতি ।প্রাগৈতিহাসিক যুগে ইউরোপেও  জুমচাষ হতো।পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং  চট্টগ্রামের বাইরে এক সময় জুমচাষ হতো শালবন এলাকায়  বিশেষ করে মধুপুরেজমিদাররা বন বাঁচিয়ে জুম চাষ করতে দিতেন গারোদেরকে। কোনো এক জায়গায় গারোরা বড় বেশি হলে তিন বছর  জুমচাষ করতেন ।তারপর সেখানে শাল ও স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগাতে।হতো যাতে সেখানে আবার বন তৈরি হয় । যারা জুমচাষ করতেন  তারাই আবার বন গড়ে তোলার জন্য লেগে যেতেন ।

ব্রিটিশ  আমল জুড়েই মধুপুরে  জুমচাষ হয়েছে। এ সময় প্রাকৃতিক বন বেশ ভালোই ছিল  আদিবাসীরাও শান্তিতে বসবাস করেছেন।বন বিভাগ সৃষ্টি হলে সরকারি এ বিভাগটির হাতে বন ব্যবস্থাপনা ন্যস্ত হয় । এরপরই মধুপুরে জুমচাষ  বন্ধ করে দেয়া হয় কিন্তু দেখা গেল বন বিভাগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেবার পর থেকেই। বনসম্পদ বেশি করে নিঃশেষ হতে শুরু করেপার্বত্য চট্টগ্রামে বহু শতাব্দী পুরানো জুমচাষ ব্যবস্থা এখনো কিছু জায়গায় টিকে আছে 
জুমচাষ প্রধানত পাহাড়ের গায়ে অর্থাৎ ঢালুতে হয়ে থাকে জুমচাষি পরিবার বা গ্রাম জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের পছন্দসই জমি বেছে নেয় এরপর বড় গাছ বাদে আর সব গাছ ও ঝোপঝাড় তারা  কেটে ফেলেন (বড় গাছের নিচের দিকের গাছপালা অবশ্য ছেটে ফেলেন তারা) এরপর কাটা গাছপালা সূর্যের তাপে শুকোতে থাকে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে অর্থাৎ এপ্রিল/মে মাসে শুকনো জুমে তারা আগুন ধরিয়ে দেনপোড়ানোর পর ছাইভস্ম মাটির উপর পড়ে  থাকে জুমের শুকনো গাছগাছড়া পোড়াবার সময় মাটির    উপরিতলের খানিকটাও পুড়ে যায় এরপর জুমচাষি বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেনবৃষ্টি পড়ার পর পরই শুরু হয় বীজ বপন। জুমচাষি নানা শস্যের বীজ যেমন ধান, তুলা, তরমুজ, মিলেট, বীন, হলুদ, তৈলবীজ, তরমুজ, মিষ্টি আলু, বাংগি, আদা ইত্যাদি ধারালো লাঠি বা জুমের বিশেষ দা- এর খোচায় সামান্য গর্ত করে নির্দিষ্ট দূরত্বে পুঁতে দেন। বিভিন্ন ফসল বিভিন্ন সময় সংগ্রহের। উপযুক্ত হয় বা পাকে। যেমন, হলুদ উঠে জুলাই মাসের দিকে, তরমুজ, শাকসবজি ও ধান সংগ্রহ চলে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস জুড়ে; এবং তুলা উঠে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে। কলাগাছ লাগানো হলে তার ফল পাওয়া যাবে দ্বিতীয় বর্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জুমচাষিরা নানা রকম ফসল ফলিয়ে থাকেন। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জুমক্ষেতে কলাচাষ গুরুত্বপূর্ণ
জুমচাষ একটা পারিবারিক এবং অনেক ক্ষেত্রে সমষ্টিগত কৃষি পদ্ধতি জুমচাষে দরকার প্রচুর শ্রম এবং সার্বক্ষণিক যত্ন যে কারণে গোটা পরিবার বা গোষ্ঠী জুম চাষের  মৌসুমে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গাছ যখন ছোট তখন সার্বক্ষণিকভার আগাছা পরিষ্কার করতে হয় । গাছ যখন বড় হয় তখন বন্যশুয়োর, ইদুর, বানর, হবি ণ এবং  কোনো জায়গায় বন্য হাতির হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে সবসময় পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়। সাধারণত বয়স্ক পুরুষরা গোটা পরিবার বা গ্রামের জন্য জুমক্ষেত তৈরির জন্য জঙ্গল াটেন, মহিলা ও শিশুরা আগাছা  আগাছা পরিষ্কার করে, ক্ষেতের যত্ন নেয় এবং ফসল সংগ্রহ করে । ক্ষেতের অবস্থান ভালো হলে ভালো ফসল পাওয়া যায়
ব্যক্তি নয়, সাধারণত গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করে জুমক্ষেত। মৌজা প্রধান বা  হেডম্যান জুমের জমি গ্রামসমূহ বা পরিবারের মধ্যে বন্টন করে দেন ।  জুম পরিবার হেডম্যানকে জুমকর দেয় । হেডম্যান জুম করের একটা অংশ রেখে  দেন এবং বাকিটা সার্কেল চিফ বা রাজা এবং সরকার পায় জুমক্ষেত যে প্রথম দখল করে বা অধিগ্রহন পায় হেডম্যান সাধারণত তাকেই জুম করার অধিকার দেন
তবে রাষ্ট্রই পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জমির মালিক (পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল) জুমচাষ নিয়ন্ত্রণ করার। ক্ষমতা জেলা প্রশাসকের হাতে ন্যস্ত।যথেষ্ট কারণ থাকায় তিনি কোনো এলাকায় জুমচাষ বন্ধের ঘোষণা দিতে পারেন” (পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ-এর ৪১ ধারা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ার, পৃষ্ঠা ২৪৭)একনাগাড়ে এক জায়গায় জুমচাষ করা যায় দুই বা তিন বছর। এরপর সে জায়গা ফেলে রাখার কথা দশ বছর বা তারও অধিক সময়ের জন্য। যাতে সেখানে আবার গাছপালা ফিরে আসে। এ সময়কেফালো' বা  পরিত্যক্ত সময় বলা হয়। এ পরিত্যক্ত সময়ের প্রথম দুতিন বছর ধরে সেখানে মরিচ, শেকড় জাতীয় খাবার এবং ফলের গাছ থেকে কিছু খাদ্যপণ্য আসে জুমচাষির ঘরে । পরিত্যক্ত সময়ে জুমক্ষেত থেকে চিকিৎসার জন্য দরকারি গাছগাছড়া, জ্বালানি কাঠ এবং ঘরবাড়ি তৈরির জন্য দরকারি কাঠও সংগ্রহ করেন জুমচাষি
যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে কেবল আদিবাসীরাই বসবাস করতেন এবং পরিবার। বা মাথাপিছু পর্যাপ্ত জমি ছিল তখনফালো' বা পরিত্যক্ত  সময়ও ছিল যথেষ্ট কাজেই এক জায়গায় এক দুই বছর জুমচাষ করে জুমিয়া পরিবার চলে যেত। অন্য জায়গায়। অনেক বছর পর সে যখন আবার ফিরে আসত তখন সেখানে  জঙ্গল তৈরি হয়ে গেছে। এটাই ছিল স্বাভাবিক অবস্থা। জুমচাষি জানেন কখন  জুমক্ষেত পরিত্যাগ করতে হবে যাতে জঙ্গল তৈরি হতে পারে । প্রাচীন এ চাষ পদ্ধতি থেকে উৎপাদন কম হলেও এটি একটি টেকসই চাষ পদ্ধতি। ক্রান্তীয় দেশের রেইন ফরেস্টে এ চাষ পদ্ধতি চলছে হাজার বছর ধরে। তাছাড়া জুম চাষির দক্ষতা ও জ্ঞানও গুরুত্বপূর্ণ। সে বন ও পরিবেশ উভয় বাঁচিয়ে জুমচাষ করতে পারে। তবেফালোবা  পরিত্যাক্ত সময়ের ব্যাপারে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অনেক গবেষক বলেছেন যে দশ বছরের পরিত্যক্ত সময়ও যথেষ্ট নয়। পেরুর আমাজন এলাকায় গবেষণা করে জিওফ্রি স্কট বলেছেন। পরিত্যক্ত সময় ১৫ বছর যা তারও অধিক হলেই তবে জুমচাষ টেকসই হতে । পারে (মারচাক ১৯৯ - এবার আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে তাকাই তবে গভীর সমস্যা দেখি 
ঔপনিবেশিক শাষকরা জুমচাষের বিরোধী ছিলেন এবং ঔপনিবেশিক। শাষন আমল থেকেই জুমচাষ বন্ধের চেষ্টা চলছে। বর্তমান সময়ে সরকার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা উনয় প্রকল্পেযার অধিকাংশই বন ও বনের অধিবাসীদের জন্য ক্ষতিকরঋণ - অনুদান দিচ্ছে তারা সব সময় বলে চলেছে জুমচাষ একটি ক্ষতিকর চাষ পদ্ধতি জুমচাষের সমস্যাই ছিল ১৯৭৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন  প্রকল্পের একটি মূল আলোচনার বিষয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আর্থিক সহায়তার  তৈরি এ প্রকল্পে ২০০০ সাল নাগাদ নানা কর্মকাণ্ডের প্রস্তাব করা হয়  জুমচাষের বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করার জন্য এডিবি নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত উৎপাদন করে এর এক হিসাবে বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বছরে ৪২ লক্ষ টন মাটি (টপ সয়েল) হারাচ্ছে এর ফলে উর্বর মাটি কেবল হারিয়েই যাচ্ছে তা নদী ও কাপ্তাই লেক ভরাট করে ফেলছে (পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ এবং এডিবি, চিটাগং হিল ট্রাক্টস্ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, মেইন রিপোর্ট ১৯৭৮, পৃ.৪৭)
১৯৬০-এর দশকে ফরেস্টাল ফরেস্ট্রি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল পার্বত্য চট্টগ্রামে মাটি ও মাটির ব্যবহার নিয়ে যে জরিপ চালায় তাতে আন্তর্জাতিক একটি পরামর্শক দল দাবি করেন জুমচাষ মারাত্মক ক্ষতিকর। পাকিস্তান সরকার। কানাডীয় এ কোম্পানিকে নিয়োগ  করেছিল ফরেস্টাল ফরেস্ট্রি অ্যান্ড। ইন্টারন্যাশনাল এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অনেক ভলুমের গবেষণাপত্রে। জুমচাষের কঠোর সমালোচনা করে জুমচাষকে যথাশীঘ্র খুব সীমিত করে  আনার  সুপারিশ করা হয় এবং পর্যায়ক্রমে জুমচাষের পরিবর্তে স্থায়ী চাষ। পদ্ধতির সুপারিশ করা হয় কিন্তু প্রকৃ্ত কী সব কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে এবংফালোবা পরিত্যক্ত সময় কমে গেছে; সে ব্যাপারে বাইরের এই দুই প্রতিষ্ঠান কোন রকম  আলোকপাত বা বিবেচনাই করেনি
জুমচাষের নিন্দা জমি দখলের জন্য নিয়মিত ঔপনিবেশিক অভ্যাস যা ইতিহাস সাক্ষি। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলেও ধনী দেশগুলোর  ঔপনিবেশিক মানসিকতার বড় একটা পরিবর্তন হয়নি । বরং তাদের মানসিকতা সঞ্চারিত হয়েছে সাবেক ঔপনিবেশসমূহের শাসকদের মধ্যে । কর  আদায় ও বন সম্পদ  লুণ্ঠন করার জন্য এবং বন সংরক্ষিত করার জন্য ব্রিটিশ শাসকেরা জুমচাষে  জোর নিন্দা করেছে। একই মানসিকতা নিয়ে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে নানা উন্নয়ন প্রকল্প । তার ওপর বিপুল সংখ্যক বাঙালির অভিবাসন ঘটেছে পাহাড়ি এলাকায় । সমতলের বাঙালি পাহাড়ি এলাকার চাষ পদ্ধতি বুঝবে না সেট। স্বাভাবিক । নানা অন্যায় অবিচারে অতিষ্ট হয়ে পাহাড়িদের একটি অংশ যখন সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়  বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য যাদের উপস্থিতি গত তিরিশ বছর ধরে  সেখানে সর্বত্র।
একটি অঞ্চলে সামরিকীকরণ বন, পরিবেশ এবং স্থানীয় মানুষের জন্য যে কত বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম তার একটি বড় উদাহরণ পাহাড়ি এলাকায় রাবার চাষ এবং বিদেশী প্রজাতির গাছ দিয়ে বাণিজ্যিক শিল্পবন আরো ক্ষতিকর বনায়ন কর্মসূচি পার্বত্য  চট্টগ্রামে প্রান্তিক মানুষদেরকে আরো দরিদ্র করেছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  এবং সামরিকীকরণ পার্বত্য চট্টগ্রামের সব কিছু উলোট পালট করে  দিয়েছে এ অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি মানুষ আজ অভ্যন্তরীণ উদ্ধাস্তু পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার ও জুমচাষ এবং শাসকরা যে উন্নয়ন মডেল চালু করতে চায় তার মধ্যে ঘোরতর বিরোধ সে কারণে জুমচাষের এতো নিন্দা জুমচাষের সার্বক্ষণিক নিন্দা করে  ব্রিটিশ শাসকেরা নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে চেয়েছে বর্তমান শাসকেরা এবং সংশ্নিষ্ট বিদেশী সংস্থাসমূহ একই কারণে জুমচাষের নিন্দায় মুখর জুমচাষ সার্বিক অর্থে খারাপ, ঔপনিবেশিক আমলের এ প্রচারণা বর্তমান সময়ে | পরিত্যক্ত হয়েছে দেশে দেশে তবে অনেক  রাজনীতিকের মধ্যে এখনো জুমচাষের কঠোর সমালোচনার অভ্যাস থেকে গেছে সমালোচকেরা পাহাড়ি এলাকায় জমি ব্যবহারের  ক্ষেত্রে জুমচাষের ভালো দিকগুলো দেখতে নারাজ কারণ এরা সাধারণত বহিরাগত এবং সেখানে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতা চলছে
জুমচাষ নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণে ঐতিহ্যগত এ চাষ পদ্ধতির সারমর্ম বোঝা দরকার। ঐতিহ্যগতভাবে এশিয়া এবং পৃথিবীর অনেক দেশে পাহাড়ি এলাকার জন্য জুমচাষ খুবই উপযোগী চাষ পদ্ধতি । পৃথিবীর ব্যবহারযোগ্য। জমির ৩০ শতাংশের মত জুমচাষের আওতায় যার ৪০ শতাংশ আবার এশিয়ার দেশসমূহে । উত্তর পূর্ব ভারতীয় হিমালয় অঞ্চলে জুমচাষ একটি প্রধান চাষ  পদ্ধতি । এক হিসেব মতে এ অঞ্চলের  ১৬ লক্ষ মানুষ বিয়াল্লিশ কোটি ষাট লক্ষ হেক্টর জমিতে জুমচাষ করে বেঁচে আছেন। ভারতীয় হিমালয় অঞ্চলের নাগাল্যান্ড  রাজ্যে মাত্র এক দশকে এক হাজার বর্গমাইল নতুন এলাকা জুমচাষের আত্ততায় আনা হয় । ফালো  বা পরিত্যক্ত সময় ১৪ বছর থেকে (৫)পাচ বছর কমে যাওয়াই এই অবস্থা (আলম এবং খিসা ১৯৯৮) বাংলাদেশেও অবস্থা অনেকটা একই রকম । ফালো  বা পরিত্যক্ত সময় মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে এবং সরকার জোর তৎপরতা চালালে ও জুমচাষ বন্ধ হচ্ছে না । কারণ এতো প্রাচীন চাষ পদ্ধতি।  পরিত্যক্ত সময় মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার জন্য দায়ী তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অন্যান্য অবস্থা যা আগে আলোচনা করেছি জুমচাষ বন্ধ করতে বলার অর্থ হলো জমি ছেড়ে পাহাড়িদেরকে যে  কোনো দিকে চলে যেতে বলা । বস্তুত শিল্পবন ও অন্যান্য কারণে জুমচা করতে না পেরে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো কোনো জায়গার  পাহাড়ি অনেক মানুষ নিজেদের গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থালী এমন একটি থানা যেখানে পাল্পউড প্লান্টেশনের কারণে জুমচাষ অনেক এবং এ থানার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী খিয়াং-দের বহুপরিবার নিজেদের গ্রাম ছেড়ে  কোথায় চলে গেছে তা আর কেউ বলতে পারেন না
পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব ভুল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে এবং বাঙালি পাঠিয়ে যেভাবে কৃত্রিম জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা যদি না হতো  এবং পাহাড়ি  যদি শান্তিতে বসবাস করতে পারতেন তবে পাহাড়ে পাহাড়ে জুমচাষও হতে এবং অমূল্য বৃক্ষসম্পদ এবং প্রাণবৈচিত্র্য ও রক্ষা পেতো । পাহাড়ি জুমচাষী  নানা চাপে আজ দিশেহারা । তার ঐতিহ্যগত জ্ঞান , বাংলার মা ধানের বীজ  ও প্রযুক্তি বিপন্ন শুধু তাই নয় এখন বাংলার কোথাও আর নিজের বলে কোন ধানের বীজ নেই ।
জুমচাষ নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক গবেষণা হয়েছে এবং এসব গবেষণার  ফলাফলে প্রাচীন এ চাষ পদ্ধতির কল্যাণকর দিকসমূহ লিপিবদ্ধ হয়েছেজুমচাষে শস্য নয়, জমি পাল্টায় জুমচাষি । এর ফলে জুমচাষের জমিতে। রোগবালাই ক্ষতিকর কীট ও  আগাছা বাসা বাধতে  পারে না (হুইটমোর ১৯৯৮:১৫৭) জুমচাষ মাটি ক্ষয় করে এমন  ধারণাও বিশেষজ্ঞরা প্রত্যাখান করেন। একদল বিজ্ঞানী লাতিন আমেরিকায় (বিশেষ করে ব্রাজিলে) ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে জুমচাষের উপর গবেষণা করে বলেছেন, “চাষের। সময় মাটিতে পুষ্টির পরিমান খুব একটা কমেনি, তবে ফসফরাসের পরিমাণ কমেছে যার ফলে ফসল উৎপাদন কম হয়ে থাকতে পারে জুমক্ষেত পরিত্যাগ করার পর স্থানীয় প্রজাতির গাছপালা দ্রুত বেড়ে উঠে । মাটিতে ফসফরাস ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় প্রজাতির বৃক্ষসমূহ নিঃসন্দেহে বিদেশী প্রজাতির গাছ দিয়ে লাগানো বন থেকে বেশি  উপযোগী এবং দরকারি (মারচাক ১৯৯৫:১৬৪) পার্বত্য চট্টগ্রামে  ব্রিটিশ আমলে এবং তার পরে বিভিন্ন সরকার সেগুন, রাবার  এবং আগ্রাসী প্রজাতি দিয়ে পাল্পউড প্লান্টেশন করেছে । অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী এবং দাতাদের টাকায় এসব কৃত্রিম বন করা হয়েছে । এই বিদেশী প্রজাতি দিয়ে বনায়ন কোনোভাবেই জুমচাষের বিকল্প হতে পারে না । জুমচাষ বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত চাষ পদ্ধতি যা মাটির ক্ষতি না  করে হাজার বছর ধরে চলেছে ।
তবে জুমচাষ নিয়ে উদ্বেগের কারণ হলো  এরফালো বা পরিত্যক্ত  সময় মারাত্মকভাবে কমে গেছে অনেকে জুমচাষের জায়গায় হর্টিকালচার করতে আগ্রহী । তবে যে কথাটি মনে রাখা দরকার, তা হলো  ‘ফালোবা পরিত্যক্ত সময় জুমচাষিদের কারণে কমে যায়নি  এবং জুমচাষ পার্বত্য চট্টগ্রামে বন  বিনাশের বড় কোনো কারণ নয় । বাইরের অনেকে না বুঝে, স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন । মহলের কথা বিশ্বাস করে জুমচাষকে বন বিনাশের প্রধান কারণ মনে করে থাকেন । পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বনাঞ্চলের অবস্থা ও সমস্যা । বোঝার জন্য আরো কিছু জরুরি বিষয় আলোচনা করছি

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post