আমাদের দেশে জমিজমা সংক্রান্ত নানারকম কাগজপত্র আছে। একেকটার একেক রকম নাম। জমি কেনাবেচা করতে এসব কাগজপত্রের দরকার হয়। জমিজমার কাগজপত্র না বুঝলে প্রায়ই ঠকতে হয়। জমি কিনে বা বেচে হয়রানী হতে হয়। এমনকি মামলামোকদ্দমায় জড়াতে হয়। এখানে জমিজমা বিষয়ে কিছু কাগজপত্রের পরিচিতি দেয়া হলঃ
মৌজাঃ সরকার সময় সময় জমি জরিপ করে। জরিপ করার সময় জমির একটি সীমানা। ঠিক করা হয়। এই সীমানাকে মৌজা বলে। একটি গ্রামে একটি মৌজা হতে পারে বা আবার কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি মৌজা হয় । বাংলাদেশে মোট ৬৮,৬০৮টি মৌজা আছে।।
 নক্সাঃ  ভূমি জরিপ বিভাগের সীমানা ঠিক করে দেয়া ম্যাপকে নক্সা বলে। এই নক্সায় মৌজার জমিতে যত খন্ড আছে তার ছবি পাওয়া যায়। নক্সায় 


মালিকানা অনুযায়ী জমির সীমানা আঁকা থাকে। সীমানার মধ্যে দাগ নম্বর লেখা থাকে। এছাড়া পরিচিত স্থানগুলাে। চিহ্নিত থাকে এজন্য যে, যাতে দাগগুলো বোঝা যায় । সিট মৌজার প্রতিটি নক্সাকে সিট বলে। একটি মৌজার পুরোটা  একটি কাগজে করা। সম্ভব না হওয়ায় তৎকালিন কাগজের সাইজের উপর ভিত্তি করে একটি মৌজাকে একাধিক সিটে ভাগ করা হয়েছে। একটি মৌজায় একাধিক সিটও আছে। তবে প্রত্যেকটি মৌজায় সিট নাম্বার ১ থেকে শুরু করা হয়। একটি সিট থাকতে পারে বা একের অধিক থাকতে পারে।

খতিয়ানঃ খতিয়ান অর্থ হিসাব। একটি মৌজায় এক বা তার অধিক ব্যক্তির জমি থাকে। এ সমস্ত ভূমি মালিকানার বিবরণ অর্থাৎ ভূমির পরিমাণ, মালিকের নাম, পিতা, স্বামীর। নাম ঠিকানা, অংশ, দাগ নম্বর, জমির শ্রেণী, দেয় খাজনার পরিমান ইত্যাদি তথ্য যেখানে লেখা থাকে তাকে খতিয়ান বলে। বর্তমানে যে খতিয়ান চালু আছে তাকে হাল খতিয়ান বলে। যেমন ঃ সি.এস. খতিয়ান, আর.এস খতিয়ান, বিআরএস খতিয়ান। বিআরএস খতিয়ান দুই ধরনের, যথা (১) জরিপ খতিয়ান (২) খারিজা খতিয়ান।
পরচা/পর্চাঃ  খতিয়ানের পুরো বিবরণ যে কাগজে লেখা থাকে তাকে পর্চা বলে । জরিপের সময় প্রাথমিকভাবে জমির পরিমাণ, দাগ নম্বর, জমির শ্রেণী ইত্যাদি সংশোধনের পর যে। খসড়া খতিয়ান তৈরী করা হয় এর একটি অনুলিপি/কপি  মালিককে দেয়া হয়। খতিয়ানের এই অনুলিপি পর্চা নামে পরিচিত। পর্চা দুই ধরনের থাকে ঃ (১) মাঠ পর্চা। (২) খারিজা পর্চা। মাঠ জরিপ করার পর মালিককে যে কাগজ প্রদান করে তা হলো মাঠ। পর্চা এবং খারিজ করার পর  মালিককে যে কাগজ প্রদান করে তা খারিজা পর্চা।
জে.এল, নম্বরঃ একটি উপজেলার এক বা একের বেশী মৌজা থাকতে পারে। প্রতিটি উপজেলার অবস্থিত মৌজাসমূহকে সহজে চেনার জন্য ভিন্ন  ভিন্ন নম্বর দেয়া হয়। উত্তরপশ্চিম কোণ হতে পর্যায়ক্রমে একটি করে নম্বর দেয়া শুরু হয় এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। তা শেষ হয়। মৌজার এই পরিচিতিমূলক ক্রমিক নম্বরকে জে এল নম্বর বা জরিসডিকশন লিষ্ট নম্বর বলে। প্রতিটি উপজেলার মৌজাসমূহের আলাদা জে এল নম্বর  দেয়া হয়।

দাগ নম্বরএকটি মৌজায় বিভিন্ন মালিকের বা একই মালিকের বিভিন্ন শ্রেণীভূক্ত জমি থাকতে পারে। জমিগুলো বিভিন্ন আকারে বা খন্ডে ভাগ করা  থাকে। এই খন্ড করা জমির বিবরণ, হিসাব ও পরিচয়ের জন্য যে আলাদা পরিচিতি নম্বর দেয়া হয় তাকে। দাগ নম্বর বলে। মৌজা ম্যাপের উত্তর-পশ্চিম কোণ হতে দাগ নম্বর দেয়া শুরু হয়। এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এসে শেষ হয়। প্রতিটি মৌজায় ১ থেকে দাগ নম্বর শুরু হয়। এবং মৌজার জমি যুতগুলো  খন্ডে ভাগ থাকে ততগুলো দাগ নম্বর দেয়া হয়  দাগ। নম্বর সরেজমিনে দেখা  যায় না। জরিপ বিভাগের তৈরী মৌজার নক্সায় দেখা যায়। প্রতিটি মৌজার জন্য আলাদা নক্সা থাকে। প্রত্যেক মৌজার নক্সা জেলা প্রশাসকের অফিসে পাওয়া যায়। কোন সময় ভুলবশত জরিপ করার সময় কোন দাগ যদি বাদ পড়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে প্লটের দাগ নম্বর দেওয়া হয়, তখন তাকে ছুট দাগ বা বাট্টা দাগ বলে ।
 তৌজিঃ  ১৮০০ সালের ৮নং রেজুলেশনের বিধান মোতাবেক  কালেকটরেট প্রত্যেকটি জমিদারের ভূমির খাজনা ইত্যাদির বিবরণ লিপিবদ্ধ করার জন্য একটি রেজিস্ট্রার ব্যবহার করা হতো । এই রেজিষ্ট্রারে ব্যবহৃত ক্রমিক নম্বরকে তৌজি নাম্বার বলে । তৌজি জেলা অফিসে জেলা রেজিস্ট্রারের নিকট সংরক্ষিত থাকে।
তফসিল ঃ কোন জমি যে মৌজায় অবস্থিত সে মৌজার নাম, জে. এল নম্বর, খতিয়ান নম্বর, জমির চৌহদ্দির বিবরণ ইত্যাদির পরিচিতি সম্বলিত বিবরণকে ঐ জমির তফসিল বলে।
পাট্টাঃ জমিজমা ভোগ দখলের অধিকার দিয়ে মালিকপক্ষ জমিদার  প্রজাকে যে। লিখিত অধিকারপত্র দিত তাকে বলা হতো পাট্টা । মূলতঃ জমিদারী আমলে এর প্রচলন ছিল, তবে এর প্রচলন এদেশে প্রথম শুরু হয় সম্রাট শের শাহের আমলে। (১৫৪০-৪৫)।
কবুলিয়তঃ  মালিকের দেয়া পাট্টাকে কবুল করে প্রজা বা রায়ত যে লিখিত স্বীকৃতি পত্র দিত তাকে কবুলিয়ত বলা হতো ।
দলিলঃ দলিল হচ্ছে মালিকানা প্রমাণের লিখিত সাক্ষ্য। জমির মালিকানার  রেজিষ্ট্রিকত কাগজকে দলিল বলে । দলিল ছাড়া জমির মালিকানা পাওয়া যায় না। তবে মালিকানা। চুড়ান্ত করতে হলে নাম পত্তন করতে হয়।
দাখিলাঃ ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের পর তহশীল অফিস হতে ভূমি  মালিককে যে রশিদ। দেয়া হয় তাকে দাখিলা/চেক দাখিলা বলে।
ডিসিআরঃ  ভূমি কর ব্যতিত অন্যান্য সরকারি পাওনা আদায় করার পর যে রশিদ দেয়া। হয় তাকে ডিসিআর বলে । ডিসিআর-এর অর্থ ডুপ্লিকেট কার্বন রিসিট। জমি নামজারী। বা খারিজা করার পর মালিক হিসেবে ডিসিআর প্রদান করা হয়ে থাকে ।
জোতঃ  রায়ত (কৃষি প্রজা) অথবা অধিনস্থ রায়ত কর্তৃক অধিকৃত কোন ভূমির খন্ড বা খন্ডসমূহ অথবা ঐ বিষয়ের অবিভক্ত অংশকে বলে যা কোন প্রজাস্বত্ব হিসেবে গঠিত।
রায়ত রায়ত বলতে কৃষি প্রজাকে বুঝায়।
নাল জমিঃ  আবাদযোগ্য সমতল কৃষি জমিকে নাল জমি বলে।
চান্দিনা ভিটাঃ  হাটবাজারের ভিটি এলাকাকে চান্দিনা ভিটা বলে।
সায়রাত মহলঃ  সায়রাত আরবী শোহরাত শব্দের বিবর্তনমূলক শব্দ এর অর্থ প্রকাশ্য  স্থানকে বুঝায়। যে সকল ব্যবহার্য স্থানসমূহ সরকার বার্ষিক লীজ দিয়ে অথবা স্বল্প মেয়াদী লীজের মাধ্যমে রাজস্ব প্রাপ্ত হন তাকে ভূমি ব্যবস্থাপনায় সায়রাত মহল বলে। এরুপ লীজ দ্বারা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির স্বত্ত্ব হস্তান্তরিত হয় না এবং ঐ সকল। স্থানে জনগণের চলাচল এবং ব্যবহারও সাধারণত: ব্যাহত হয় না। পাথর মহাল, বালু মহাল, জল, হাটবাজার, ফেরী ঘাট ইত্যাদি সায়রাত মহলের অন্তর্ভূক্ত।
লায়েক পতিতঃ যে জমিতে ফসল উৎপাদন করা যায় কিন্তু তা না করে পতিত রাখা। হয়েছে এই প্রকারের জমিকে লায়েক পতিত জমি বলে।
বাটা  দাগঃ নক্সায় ভুল বসত কোন পটের নম্বার বাদ পড়লে মৌজার শেষ  পট নম্বরটির পরের নম্বর নিচে লিখে এবং বাদ পড়া পটের ঠিক উপরের পটের নম্বরটি উপরে লিখে (ভগ্নাংশের ন্যায়) প্রাপ্ত যে নম্বর দিয়ে বাদ পড়া পটটি চিহ্নিত করা হয় তাকে বলে বাটা দাগ।
ছুট দাগঃ  নক্সায় দাগ নম্বর বসানাের সময় ভুলবসত ও কোন একটি অংক/সংখ্যা বাদ। পড়লে অর্থাৎ ছুটে গেলে তাকে বলে ছুট দাগ। যেমন ১,২,৩, বসানোর পর ৫ ও ৬ বসিয়ে ফেলা এখানে ৪ ছুট দাগ। অর্থাৎ ঐ  নকসায় ৪ নম্বর নামে কোন পটের। অস্তিত্ব নেই।
হোল্ডিংঃ একটি খতিয়ানে একটি দাগ থাকতে পারে আবার একাধিক দাগও থাকতে পারে। এরূপ একটি খতিয়ানের অন্তর্ভূক্ত ভূমিকে হোল্ডিং বা জোত-জমা বলে। হোল্ডিং এর পরিচিতি নম্বরকে হোল্ডিং নম্বর বলে ।
পেরীফেরীঃ হাট  বাজারের আয়তন প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হয়ে থাকে।  এরূপ সম্প্রসারিত অংশকে বাজারের অন্তর্ভুক্ত করা, হাট-বাজারের তোহামহাল, চান্দিনা। ভিটি ও বন্দোবস্তযােগ্য খাসজমি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে সার্ভেয়ার দ্বারা সরে জমিনে পরিমাপ পূর্বক হাট-বাজারের নক্সায় তৈরীসহ চতুসীমা নির্ধারণ করাকে বলে পেরীফেরী ।
আসাবা (রেসিডুয়ারী)ঃ আসাবা বা রেসিডুয়ারী শব্দের অর্থ অবশিষ্টাংশ  ভোগী । মুসলিম আইনে তিন ধরনের উত্তরাধিকারের মধ্যে আসাবা এক ধরনের। উত্তরাধিকারী। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের ৬১ ধারায় অবশিষ্টাংশ ভোগী বলতে তাদের বলা হয়েছে যারা সম্পত্তির কোন নির্ধারিত অংশ প্রকারের জমিকে লায়েক পতিত জমি বলে ।
নামপত্তন/ মিউটেশনঃ জমি কেনার পর উপজেলা রাজস্ব অফিসে নাম  পত্তন। করতে হয়। অর্থাৎ আগের মালিকের পরিবর্তে যে জমি কিনেছে তার নাম লেখাতে হয়। এই নাম লেখানোকে নাম পত্তন বা মিউটেশন বলে। নাম পত্তন না হলে জমির মালিকানা চুড়ান্ত হয় না। কারণ অনেক সময় একই জমির। একাধিক দলিল থাকতে পারে। সাধারণতঃ দেখা যায় একটি জরিপ থেকে আর একটি জরিপ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ বৎসর সময় লাগে। এই সময়ের। মধ্যে জমির অনেক মালিকের মত্যর ফলে অনেক অংশে ভাগ হয়। আবার জমি। অন্যত্র বিক্রয়ও হয় এর ফলে জমির মালিকানার পরিবর্তন হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে বা বিক্রয় সূত্রে জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে খতিয়ানে নতুন মালিকের নাম সংযুক্ত করাকে নাম পত্তন রেকর্ড বা মিউটেশন বলে। যেভাবেই জমি। পাওয়া যাক না কেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিউটেশন করা ভালো।
জমির মালিকানা/ স্বত্ত্ব প্রমাণের শর্তঃ  কাউকে কোন জমির মালিকানা বা স্বত্ত্ব প্রমাণ করতে হলে তাকে নিম্নের কাগজপত্র ও শর্ত পূরণ করতে হবে। ক. রেজিষ্ট্রিকৃত বৈধ দলিল থাকতে হবে। খ. জমিতে দখল থাকতে হবে । গ. মিউটেশন করতে হবে অর্থাৎ খতিয়ানে জমির মালিক হিসেবে নিজের নাম পত্তন করতে হবে । রেকর্ড অব রাইস ।
ঘ. হালনাগাদ খাজনা রশিদ/ দাখিলা থাকতে হবে ।

“খতিয়ান, ডিসিআর এবং খাজনা রশিদ যদি থাকে।
জমির নাম খারিজার নিশ্চয়তা তবেই মিলে।”

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post