চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলক রাবার চাষ শুরু হয় ১৯৫৯ সালে রাবার উন্নয়ন প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় ১৯৬৯ সালে সরকার প্রাথমিকভাবে ৪০ হাজার একর ভূমিতে রাবার চাষের পরিকল্পনা নেয় কিন্তু ১৯৮৮ সাল নাগাদ ২৫ হাজার একর জমি রাবার চাষের আওতায় আনা  সম্ভব হয় দ্বিতীয় রাবার উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৮৭ সালে  মধুপুরে রাবার চাষ শুরু হয় মধুপুরে প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে ১৫ হাজার একর জমিতে রাবার চাষ করতে পারেনি কতৃপক্ষ এখানে ৭ হাজার ৮শ একর জমিতে রাবারের চাষ হয়েছে বাবার চাষ অর্থনৈতিক কী সুফল এনেছে সে ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ পত্রপত্রিকার রিপোর্ট এবং বিভিন্ন জায়গায় যা দেখেছি তাতে রাবার চাষ   থেকে আর্থিক বড় কোনো লাভ হয়েছে এমন মনে হয় না

অনেকের অভিমত রাবার চাষের জন্য যে পরিমাণ জমি ও অর্থ ব্যবহার হয়েছে এবং বিনিময়ে যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে একে একটি ব্যর্থ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই বলা। ভালো রাবার চাষ যেখানে হয়েছে সেখানে পরিবেশ নষ্ট হয়েছে তাছাড়া অনেক জায়গায় রাবার চাষ সংঘাতের সৃষ্টি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মধুপুরে যেখানে আদিবাসীদের বসবাস সেখানে রাবার চাষ করতে গিয়ে  আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুন্ন করা হয়েছে এসব জায়গায় আদিবাসীদের অনেকে রাবার চাষ কর্তৃপক্ষ ও বন বিভাগের সাথে দীর্ঘমেয়াদি বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন।
মধুপুরে রাবার চাষ শুরু হলে সেখানকার আদিবাসী গারোরা তাদের  ঐতিহ্যগত আবাস ভূমির ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়েন রাবার চাষ কর্তৃপক্ষ কেবল তাদের ঐতিহ্যগত অধিকারের জমিতেই হাত দেয়নি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের রেকর্ড করা জমিও রাবার চাষের জন্য নিয়ে নিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে বসতভিটা এবং বাড়ির আঙ্গিনাতে চলে এসেছে রাবার চাষ এর ফলে মধুপুরে রাবার চাষ কর্তৃপক্ষ এবং গারো-বাঙালিদের মধ্যে বিবাদ ও উত্তেজনার সুষ্টি হয়েছে স্থানীয় মানুষদের প্রতিরোধের মুখে রাবার চাষ শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের  কাঙিক্ষত পরিমাণ জমিতে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক রাবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি নিয়ে সমালোচকরা  আগেই  সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন কর্তৃপক্ষ রাবার চাষ শুরু করার সময়  বলেছিলেন যে রাবার চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে এবং এর উৎপাদন ক্ষমতা হবে মালয়েশিয়ার সমান। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে যখন রাবার উৎপাদন শুরু হলো তখন দেখা গেল  লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রকৃত উৎপাদন অনেক কম অনেক রিপোর্ট অনুযায়ী রাবার চাষ একটি ব্যর্থ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
আরো অনেক ব্যর্থ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মতো দুনীতিই যে রাবার   চাষে ব্যর্থতার একটি অন্যতম কারণ সে কথা বলেন অনেকে রাবার মনোকালচার পরিবেশের জন্য খুব স্পর্শকাতর একদিকে রাবার চাষ যেমন মনোকালচার হিসেবে মধুপুর এবং অন্যান্য জায়গায় চাষ হয়েছে। অন্যদিকে রাবার বাগানের প্রতি প্রয়োজনীয় যত্ন ও নেয়া হয়নি। প্রাকৃতিক বন  যেমন শালবনের প্রাণবৈচিত্র্য অনন্য। রাবার ও বাণিজ্যিক বনায়নের মাধ্যমে এ প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ১৯৮৬ সালে মধুপুরে যখন রাবার চাষ শুরু হয় তখনও শাল কপিস রক্ষা করে মধুপুরে শালবন ফিরিয়ে আনা যেত। এমন অনেক জায়গা কেটে পরিস্কার করা হয়। প্লান্টেশন বা বনায়ন, আনারস ও কলাচাষ এবং কৃষিজমি সম্প্রসারণের জন্য কপিসকাটা এখনো অব্যাহত  আছে। রাবার চাষ বা তথাকথিত বনায়ন করতে গিয়ে কেবল কপিসই কাটা হয় নি গাছ কাটার পর কর্তিত এলাকার মোথা পর্যন্ত উপড়ে ফেলা হয়েছে ফলে যেখানে রাবার চাষ হয়েছে সেসব  জায়গায় প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই বলা  চলে
অনেক বিশেষজ্ঞেরই ধারণা রাবার চাষের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনা বা মিশ্রবন তৈরিই ছিল দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বেশিলাভজনক   রাবার চাষ যেখানে হয়েছে সেখানকার আদিবাসী বা স্থানীয়  জনগণ বন থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছেন ফলে বনের অধিবাসীদের সাথে বনের যে সম্পর্ক সেটি নষ্ট হয়েছে। বনকে ঘিরে স্থানীয় মানুষের যে জ্ঞান তাও আর বিশেষ কোনো কাজে লাগছে না স্থানীয় মানুষ তাদের চোখের সামনে বন বিনষ্ট হতে দেখেছেন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে নিজেদেরকে অসহায় দেখে  বনরক্ষার চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে নিরুপায় হয়ে বন বিনাশের  প্রক্রিয়ায়ও জড়িয়ে পড়েছেন। রাবার চাষের সময় মধুপুরের মানুষকে  বিশেষভাবে আদিবাসীদেরকে বেশি ক্ষুব্ধ হতে দেখা গেছে। কিছু পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মীও মধুপুরে দ্বিতীয় রাবার উন্নয়ন প্রকল্পের শুরুতে রাবার চাষের সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতির দিকসমূহ তুলে ধরেন। দ্বিতীয় রাবার উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বে রাবার চাষে সম্ভাব্য ঋণদাতা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাথমিক জরিপ ও বিশ্লেষণ করে এ প্রকল্পে শেষ পর্যন্ত ঋণ দেয়নি। স্থানীয়  জনগণ এবং পরিবেশকর্মীরা এর জন্য আশ্বস্ত বোধ করেছেন গত শতাব্দীর  আশির দশকে তবে তা ছিল নিতান্তই সাময়িক ব্যাপার
অতীতে সরকারি নীতিমালায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার এবং চা উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে (ব্রামার ১৯৮৬) কিন্তু ১৯৭৮ সালে ইউএনডিপি ও এডিবির পরামর্শে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে রাবার চাষকে একটি অন্যতম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসাবে সরকারি বহুমুখী উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে তিনটি উপত্যকায় পূনর্বাসিত ২,০০০ জুমিয়া পরিবারের জন্য ৩,২৩৯ হেক্টর জমিতে রাবার চাষ সম্পন্ন করে আরো ১,০০০ পরিবারের জন্য ১ ৬১৯ হেক্টর জমিতে অন্যান্য হর্টিকালচারাল ফসলের সাথে রাবার চাষ করা হয় তবে রাবার চাষের জন্য বহিরাগত ব্যক্তিদের মধ্যেই বেশি পরিমাণ জমি সরকার বন্টন করে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফআইডিসি) এবং অন্যান্য সূত্রমতে সরকার ৪১৮ ব্যক্তির মধ্যে (যাদের প্রায় সবাই বহিরাগত) বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির প্রায় ৯,০০০ হেক্টর পাহাড়ি জমি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার চাষের জন্য বন্টন করেছে তবে এ সব জমির মাত্র ৮১০ হেক্টরে প্রকৃত অর্থে রাবার চাষ হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা  যায় রাবার চাষের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বহিরাগতরা অল্প স্বল্প কিছু রাবার চাষ করে সটকে পড়েছেন ব্যাংক থেকে নেয়া পুঁজি তারা অন্যত্র খাটিয়েছেন বা ঢাকায় বাড়িগাড়ির জন্য ব্যবহার করেছেন এমন অভিযোগও  আছে আরো অভিযোগ  এরা তাদের নামে বন্দোবস্ত দেয়া জমির গাছ কেটে তার থেকেও আয় রোজগার করেছেন  পার্বত্য চট্টগ্রামে এভাবে রাবার চাষের কড়া সমালোচনা করেন  পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মীরা তাদের অভিযোগ রাবার চাষের কারণে অনেক আদিবাসী জমির উপর তাদের ঐতিহ্যগত অধিকার হারিয়েছেন কেউ কেউ উচ্ছেদও হয়েছেন তাদের আবাসন থেকে

Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post