ভূমি জরিপ সম্পর্কে
ধারণা।
ভূমি ও ভূমির মালিকানা
বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে নকশা প্রস্তুত, মালিকানা সংক্রান্ত রেকর্ড ও পরিসংখ্যান প্রণয়ন
এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকেই ভূমি জরিপ বলা হয়। মূলত স্বতুলিপি প্রস্তুত করার জন্য এই
জরিপ পরিচালিত হয় । ভূমির উপর কার কিরূপ অধিকার তা নিরুপণ, ক্রয়-বিক্রয়, নিষ্পত্তি বা ভূমি ব্যবহারের অধিকার নির্দেশ
করে, রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত এরুপ আইন স্বীকত সর্বজনগ্রাহ্য
সনদ বা দলিলের নাম হচ্ছে স্বত্বলিপি বা রেকর্ড
অব রাইটস ।
এই উপমহাদেশের বিশেষ
করে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা অঞ্চলে অথবা অবিভক্ত বাংলার
ভূমি জরিপের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ভূমি
জরিপ পরিচালিত হয় মলত। ১৮৭৫ সালের বেঙ্গল সার্ভে এ্যাক্ট এবং ১৮৮৫ সনের বেঙ্গল টেনান্সী
এ্যাক্ট এর বিধান আনসা ভমি জরিপ প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯১৭ সালের
টেকনিক্যাল রুলস এর নির্দেশ অনুযায়ী। মৌজা ভিত্তিক নকশা এবং ১৯৫০ সালের জমিদারি অধিগ্রহণ
ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫৫ সালের প্রজাস্বত। বিধিমালা এবং ১৯৩৫
সালের এস.এস ম্যানুয়ালের বিধান অনুসারে ভূমির মালিকানা সম্পর্কিত
খতিয়ান (স্বত্বলিপি) বা ভূমির রেকর্ড প্রস্তুত
করা হয়। ভূমি জরিপের দুটি অংশ। প্রথম অংশে একটি বিল এলাকায় । (সাধারণত মৌজা) বিজ্ঞানসম্মত সঠিক নকশা প্রণয়ন করা হয়
এবং দ্বিতীয় অংশে রয়েছে প্রণীত নকশার ভিত্তিতে প্রতিটি ভূমিখন্ডের মালিকানা সংক্রান্ত
তথ্য লিপিবদ্ধ করা বা রেকর্ড করা । সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধির আওতায় সরকার কর্তৃক
প্রকাশিত গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভূমি জরিপ পরিচালিত হয়ে থাকে। সাধারণত। ভূমি জরিপ
দুই প্রকার, যেমন- পূর্ণাঙ্গ
জরিপ বা মেজর সেটেলমেন্ট অপারেশন এবং সংশােধনী জরিপ বা রিভিশনাল সেটেলমেন্ট অপারেশন।
এছাড়াও দিয়ারা জরিপ নামে পৃথক একটি জরিপের অস্তিত্ব থাকলেও। মূলত এটি একটি পূর্ণাঙ্গ
জরিপ। বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন কোন এলাকায় আংশিক জরিপ বা মাইনর সেটেলমেন্ট অপারেশনের
মাধ্যমেও ভূমি জরিপ হতে পারে।। ভূমি জরিপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হলে অবশ্যই জরিপের
উৎস, উদ্দেশ্য ও এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা প্রয়োজন । জমি জমার
মাপঝোঁকের প্রচলন বহু পুরাতন। জানা যায়, খ্রীষ্টপূর্বকালে সর্বপ্রথম
মিশরীয় সভ্যতায় ভূমি জরিপের প্রচলন ঘটে। মিশরের পিরামিডে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য থেকে
এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। মূলতঃ এই মাপঝোঁকের জ্ঞান থেকে ভূমি জরিপের উদ্ভব হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ১৩৫৭ সাল থেকে ১৩৮৯ পর্যন্ত সময়ে দিল্লীর মুসলিম শাসক সিকান্দর
শাহ তার আমলে একটি জরিপ কার্যক্রম। পরিচালনা করেন। তিনি একটি নির্দিষ্ট পরিমাপকের সাহায্যে
এই জরিপ পরিচালনা করেন যা ‘সিকান্দরী গজ’ নামে এখনও পরিচিত।
মুঘল আমলে পাঠান
সমাট শেরশাহ (১৫৪০-১৫৪৫
সালে) আবাদী জমির পরিমাণ নির্ণয়, উৎপাদিকা।
শক্তিভেদে জমির শ্রেণীবিভাগ ও উৎপন ফসলের ভিত্তিতে খাজনার হার নির্ধারণের উদ্দেশ্যে
আরও একটি জরিপ কাজ পরিচালনা করেন। তাঁর আমলে আমিন, কানুনগো সিকদার
জায়গীরদার ইত্যাদি পদের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে জরিপে ব্যবহৃত বিভিন্ন পার্সি শব্দ যেমন-
দাগ, সিকদার, সঠি কাগ খতিয়ান, কোর্ফা, সিকস্তি, পয়স্তি,পরগণা ইত্যাদি তখন থেকে অদ্যাবধি প্রচলিত আছে। শেরশাহের
পরে ১৫৮২-৮৭ সালে সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী
টোডরমল অপর একটি ভূমি জরিপ সম্পন্ন করেন। এই ভূমি জরিপের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের এক-তৃতীয়াংশ রাজত. জরিপসমূহকে নমুনা জরিপ’ হিসাবে অভিহিত করা যায়।
এরপর ভমি জরিপ সম্পর্কে
তেমন বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও এর ধারাবাস রাখা হয়েছিল। এক্ষেত্রে নবাব মুর্শিদ
কুলী খাঁর আমলে রাজস্ব ও বকেয়া দাবি আদায় চাকলায় বিশ্বাসভাজন ও বাংলাভাষী আমিন নিয়োগ
ও প্রতি পরগণায় সিকদার । সার্ভেয়ার প্রেরণ করে
আবাদী ও পতিত জমি পরিমাপ করে সংশোধিত ভূমি রেকর্ড প্রস্তুতক ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলার পতনের মাধ্যমে
বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এ দেশের শাসনভার গ্রহণ
করে। এ দেশের মানুষের কাছ থেকে রাজস্ব লক্ষ্যে কোম্পানী আমলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন
নিবর্তনমূলক পন্থা গৃহীত হয়েছিল। ভূমি জরিপের প্রবাদ পুরুষ বিখ্যাত নশাবিদ মেজর জন
রেনেল বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের এক ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কতিপয় অঞ্চলে অবস্থিত বিভিন্ন
নদী ও নদীর গতিপথের নকশা প্রস্তুতের জন্য ১৭৬৩। সাল থেকে ১৭৮২ সাল পর্যন্ত সময়কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ
জরিপ পরিচালনা করেন। যা ‘রেনেল সার্ভে নামে পরিচিত। এই জরিপ পূর্ণাঙ্গ জরিপ ছিল না। তিনি এই জরিপের
মাধ্যমে কেবল নদী ও নদীর গতি পথ অংকন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে মালিকানা সংক্রান্ত
কোন তথ্য লিপিবদ্ধ করার বিধান এই জরিপে ছিল না।
১৭৯৩ সালে লর্ড
কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হলে ভূমির মালিকানা প্রথমবারের
মত কৃষক রায়তের হাত থেকে জমিদারের হাতে চলে যায়। জমিদাররা তাদের অধীনস্ত এলাকায়
বসবাসকারী কৃষক রায়তদের কাছ থেকে ভোগ দখলাধীন জমির জন্য খাজনা আদায় করত। জমির সুনির্দিষ্ট সীমানা নির্দেশক
নকশা না থাকায় জমি-জমা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে
প্রায়ই বিরোধ ও বিশৃংখলা বিদ্যমান ছিল।। বিভিন্ন
জমিদারের জমিদারী সীমানা সংক্রান্ত বিরোধে নিরসন করার নিমিত্তে ১৮৪৬ সাল হতে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত
সময়ে থাকবাস্ট জরিপ নামে একটি জরিপ কার্য পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে জমিদারী এলাকার
সীমানা নির্ধারণের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। এ জরিপে ভূ-সম্পত্তি
ও রাজস্ব এলাকার সীমানা সুচিহ্নিত করা হয়। থাকবাস্ট জরিপ কোন বিজ্ঞানসম্মত জরিপ ছিল
না। তাই এ ভূমি জরিপ সম্পূর্ণরূপে ক্রটিহীন বা সন্তোষজনক ছিল না। এই জরিপের উপর ভিত্তি
করে রেভিনিউ সার্ভে নামে আরও একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। এ জরিপকে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক
জরিপ বলা হয়। কারণ তখনই প্রথমবারের মত এ দেশে দক্ষ আমিন নিয়োগের মাধ্যমে জরিপ কাজ
পরিচালিত হয়। তবে তা সত্ত্বেও এই জরিপ বর্তমান সময়ের মত পূর্ণাঙ্গ বা আনুপুংখিক জরিপ
ছিল না । এদেশের কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ও আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৮৮৫ সালের
বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট) প্রণীত হয়। এই আইনের ১০১ ধারার ১নং উপ-ধারায় ভূমি জরিপ
করে। রায়তের অধিকার সম্বলিত খতিয়ান বা রেকর্ড অব রাইটস প্রণয়ন করার বিধান রাখা হয়।
এ বিধানের। ভিত্তিতে ১৮৮৮ সনে বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামের রামু থানায় প্রথমবারের
মত বিজ্ঞানসম্মত ক্যাডাস্ট্রাল। সার্ভে (সিএস জরিপ) শুরু হয়। ভূমি জরিপ এমন একটি কার্যক্রম যা দক্ষ কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে বিধিসম্মত
সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে, কোন
সুনির্দিষ্ট এলাকার ভূমিখন্ড সরেজমিনে পরিমাপ করে এর আয়তন ও ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করা এবং তার মাধ্যমে একটি জরিপ এলাকার মৌজা নকশা প্রস্তুত ও
নকশার প্রতিখন্ডে ভূমির মালিক দখলদারের পরিচিতি ও ঠিকানা, ভূমির শ্রেণীবিভাগ, ভূমির
সুনির্দিষ্ট পরিমাপ উল্লেখ করে মালিকের জন্য নির্ভরযোগ্য খতিয়ান প্রস্তুত করা ।এ ভূমি
জরিপকেই প্রচলিত ভাষায় বলা হয় “সেটেলমেন্ট অপারেশন”।
ভূমি জরিপের গুরুত্ব
সমাজে বসবাসকারী
কৃষক, শ্রমিক, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য চাই
ভূমি। ভূমিকে। কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সভ্যতা, শিল্প,
মানুষের সামাজিক প্রভাব, প্রতিপত্তি এবং সর্বোপরি
সামাজিক কাঠামো ও সামাজিক স্তর বিন্যাস । মানুষের ভূমি দরকার । দেশে ভূমির পরিমাণ বাড়ছে
না তবুও জনসংখ্যা বাড়ছে গাণিতিক হারে। মাথাপিছু। ভূমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
অপর দিকে দিন দিন ভূমির মূল্য বেড়েই চলেছে । উত্তরাধিকারসূত্রে ভূমি বিভাজন বা ক্রয়-বিক্রয়ের কারণে খন্ডিত হচ্ছে ভূমি । এর মাধ্যমে কোন ভূমি মালিক বা দখলদার
মালিকানা হারাচ্ছেন । নতুন মালিক হচ্ছেন কেউ। এটি প্রতিনিয়ত একটি চলমান প্রক্রিয়া।
এর মাঝেই উদ্ভূত হচ্ছে মালিকানা নিয়ে বিরোধ। এ বিরোধ জানান দেয় যে, মালিকানা সংক্রান্ত দলিলের অসামঞ্জস্য
ও যথার্থ তথ্যাভাবের । প্রয়োজন অনুভূত হয় যথাযথ রেকর্ড অব রাইটস বা স্বত্বলিপি প্রণয়নের
তথা জরিপ কাজ সম্পাদনের ।
ভূমি জরিপের মাধ্যমে
প্রণীত রেকর্ড অব রাইটস বা স্বতুলিপি
১. ভূমিস্বত্ব নিরংকুশ ও নির্বিবাদ করে;
২. ভূমি বিবাদ নিষ্পত্তি সহজ করে । ৩. রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায় সহজ করে; ৪.ভূমি ক্রয়-বিক্রয়, হস্তান্তর প্রক্রিয়া সহজ করে; ৫. ভূমি মালিকানার ইতিহাস সংরক্ষণ করে এবং ৬. ভূমি রাজস্ব
প্রশাসনে শৃংখলা বজায় রাখে।
বিভিন্ন প্রকার জরিপ
বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে যে জরিপকার্য সম্পন্ন করা হচ্ছে তার
সাথে জড়িত বহুবিধ আইন ও বিধি । যে সকল আইন ও বিধির আওতায় ভূমি জরিপ পরিচালিত হয়
তা হলো ১৯৫০ সনের রাষ্ট্রীয় আগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব
আইন, ১৮৭৫ সালের সার্ভে আইন,
১৯৩৫ সালের সার্ভে ও সেটেলমেন্ট এ্যাক্ট, ১৯৫৫
সালের প্রজাস্বত্ব বিধিমালা, ১৯৫৭ সালের টেকনিক্যাল রুলস,
১৯৫৮ সালে জি.ই.ম্যানুয়াল
ও ১৯৯০ সালের ম ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল এবং এতদ্বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক
প্রণীত বিধি-বিধান।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে
আমাদের দেশে পরিচালিত বিভিন্ন ভূমি জরিপের বিবরণ নিরূপঃ
১. ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ (Cadastral
Survey)। ক্যাডাস্টাল
ফরাসী শব্দ ক্যাভাস্টার (cadastra) হতে উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা । এর অর্থ হলো ভূমি সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার
। অনেকের মতে, এটি ল্যাটিন শব্দ ক্যাপিটেস্ট্রাম
(Capitastrum) হতে উৎপত্তি। কোন মৌজার প্রতিটি ভং সরেজমিন জরিপ করে এর
আয়তন, অবস্থান ও ব্যবহারের ধরণ চিহ্নিত করে ঐ মৌজার একটি প্রতিচ্ছবিমলক
নকশা প্রস্তুত করা এবং ভূ-খণ্ড সমূহের প্রত্যেকটির মালিক,
দখলকারের বিবরণ সম্বলিত খতিয়ান প্রণয়ন করাই ছিল ক্যাডাস্টাল জরিপের
মূল লক্ষ্য। এর দ্বারা একটি পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ জরিপকে বুঝানো হয় । জরিপ করার মাধ্যমে
একটি মৌজার পৃথক মালিকানাধীন প্রত্যেক ভূমিখন্ডের প্রকৃত পরিমাপ ও পরিমাণ নির্ণয় করা
হয় । অতঃপর জরিপকৃত ভূমিসমূহের মালিক বা মালিকগণের নামে একটি রেজিস্ট্রার
(খতিয়ান) প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করা হয়। বঙ্গীয়
প্রজাস্বত্ব আইনের ১০১(১) ধারার বিধান মোতাবেক
বর্তমান বাংলাদেশে (পার্বত্য
চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেট জেলা ব্যতীত) ১৮৯০ সাল হতে ১৯৪০
সাল পর্যন্ত ৫০ বছর সময়ে একই সাথে কয়েকটি করে জেলাকে এই কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করে
সমগ্র বাংলাদেশে জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে এর পূর্বে ১৮৮৮ সালে পরীক্ষামূলকভাবে
কক্সবাজার জেলার রামু থানায় এই জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। জরিপকৃত খতিয়ানের নামানুসারে
এটি সিএস জরিপ' নামে সকলের কাছে পরিচিত। জেলাভিত্তিক এই কার্যক্রম
পরিচালনার কারণে জরিপের প্রদত্ত খতিয়ানকে কেউ কেউ প্রচলিত ভাষায় ডিএস খতিয়ান বা
জেলা খতিয়ান বলে থাকেন। ক্যাভাস্থল ম্যাপ ও খতিয়ান কালক্রমে এতই বিশুদ্ধতা এবং মৌলিকতা
অর্জন করে যে ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি মালিকগণ সি.এস.
রেকর্ডের উপর এখনও অবিচল আস্থা। পোষণ করেন। এই জরিপে শত ভাগ জমির সরেজমিনে
গিয়ে জমির প্রতিটি খণ্ডের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয় বলে এখনও এই জরিপের গ্রহণযোগ্যতা
বেশী।
২. এস, এ পূর্ববর্তী সংশোধনী
জরিপ (Revisional Settlement) সি.এস, জরিপ কার্যক্রম দীর্ঘ ৫৩
বছর ধরে পরিচালিত হয়। এই সময়ের মধ্যে উক্ত এলাকাসমূহের ভূমির প্রকৃতি, মালিকানা ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়, যার ফলে নতুন করে
রেকর্ড প্রণয়ন/ জরিপ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । এই ভূমি
জরিপে ভোগদখলগত যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তার হালকরণ বা সংশোধন করা হয় বলে এই জরিপ সংশোধনী জরিপ নামে পরিচিত
। সংশোধনী জরিপ মূলতঃ ১৯৪০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় শুরু হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে
জরিপ কিছুদিন স্থগিত থাকে। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে ফরিদপুর এবং ১৯৫২ সালে বাকেরগঞ্জ জেলায়
এই জরিপ কার্য সম্পন্ন। করা হয় এবং চূড়ান্ত খতিয়ান প্রকাশিত হয়। এই জরিপের বিশেষত্ব
হলো সি.এস. জরিপের মত জমির প্ৰতিখণ্ডে সরেজমিনে গিয়ে জরিপ করা হয়নি।
বর্তমানে সি.এস. জরিপে প্রণীত খতিয়ান ও
মৌজা ম্যাপের ভিত্তিতে মালিকানা বা দখলের পরিবর্তন অনুযায়ী খতিয়ান সংশোধিত হয় ।
প্রাকৃতিক কারণে কোন মৌজার এক-তৃতীয়াংশের বেশী জমির ভৌগলিক অবস্থার
যেসব পরিবর্তন হয়েছে কেবলমাত্র সে মৌজার ক্ষেত্রে। সীমিত কিস্তোয়ার জরিপের মাধ্যমে
তা সংশোধন করা হয়।
৩. এস, এ (State
Acquisition) জরিপ।
১৯৫০ সালে জমিদারী
অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে সরকার জমির মালিকানা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু
সরকারক জমিদারদের নিকট থেকে কি পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করেছে এবং তার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের
জন্য ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে স্বল্প পরিসরে একটি জরিপ কার্যক্রম
পরিচালনা। একে এস, এ জরিপ' নামে আখ্যায়িত করা হয় । এই জরিপে মাধ্যমে মালিক জমিদারের নাম এবং কে ভখণ্ডের
দখলদার প্রজার নামের তালিকা প্রস্তুতের পর তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় সাধারণকে
সরকারের অধীনে মালিকের মর্যাদা প্রদান করা হয় এবং ভূমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা সকলের জন্য ১০০ বিঘা সীমাবদ্ধ করা হয়। এস, এ জরিপে সকল মালিকের নামে হস্ত লিখিত খতিয়ান
প্রস্তুত করা হয় এবং সরকারকে প্রদেয় খাজনার পরিমাণ নির্ধারণ করে তা খতিয়ানে উল্লেখ
করা হয় । এই খতিয়ানকে এস, এ খতিয়ান বলা হয় । এই
খতিয়ান এম,আর,আর,
(Modified Rent Roll) এবং পি, আর, আর, (Provisional Rent Roll) নামেও পরিচিত। এই জরিপ কার্যক্রমের
উল্লেখযোগ্য দিক ছিল । এই জরিপটি পুঙ্খানুপুঙ্খ সংশোধনী জরিপের মত সরেজমিনে করা হয়নি
। জমিদারদের নিকট হতে আগের। প্রণীত জরিপের (সি, এস) কাগজপত্রের উপর ভিত্তি করে এই খতিয়ান দ্রুততার সাথে
প্রস্তুত করা হয়েছিল। বিধায় এই জরিপ শত ভাগ বিশুদ্ধ হয় নাই।
৪ এস, এ পরবর্তী সংশোধনী জরিপ / আর, এস (Revisional Settlement) /বি, এস (Bangladesh Survey) ভমি রাজস্ব প্রশাসন তদন্ত কমিটির
পরামর্শ মোতাবেক ১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহণ
ও প্রজাস্বত্ব। আইনের বিধান অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিশ। বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনার
আওতায় সমগ্র দেশে । সংশোধনী জরিপ কাজ সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালের মধ্যে সমগ্র দেশে জমিদারী। অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব
আইনের ৫ম খন্ড কার্যকর। হওয়ার পর সরকার খতিয়ান হালকরণের উদ্দেশ্যে ১৯৮ সংশোধনী জরিপ
কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ১৯৬৫-৬৬ সনে রাজশাহী জোনে প্রথম সংশোধনী
কাজ শুরু করা হয় । এরপর পর্যায়ক্রমে ঢাকা,
চট্টগ্রাম, পাবনা, কুষ্টিয়া
ও ময়মনসিংহ জোনে সংশোধনী জরিপ শুরু হয় ।
এর মধ্যে শুধু রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়া জোনের চূড়ান্ত।
প্রকাশনার কাজ সমাপ্ত করে রেকর্ডপত্র জেলা প্রশাসকের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্যান্য
জোনের কাজ এখনও
সংশোধনী জরিপ কার্যক্রম
অত্যন্ত ধীর গতিতে চলাতে ২০ বৎসরের মধ্যে এই
জরিপ কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। তাই প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়
জরিপ কার্যক্রমের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের। বস্তুত: এই উপলব্ধি থেকেই জোনাল জরিপ পদ্ধতির উদ্ভব
।।
৫. সিলেট জরিপ
সম্রাট আকবরের আমলে
ভূমি জরিপ কাজ শেষ হবার পরে ১৭৮৭ সালে মি: লিন্ডসে সিলেট অঞ্চলে জরিপ করেন এবং খাজনা পুনঃনির্ধারণ করেন।
১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন জারি করা কালে সিলেট তার । অন্তভূক্ত
ছিল না। তাই সিলেট জেলা সি, এস জরিপ কার্যক্রমের আওতাভূক্ত হয়নি। জমিদারী অধিগ্রহণ ও এগাস্বত্ব আইন জারি
হওয়ার পূর্বে প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৩৬ এর ১১৭ ধারা মোতাবেক ৭ জুন ১৯৫০ সালের। আর,
এস, ৩৬১৫ নং বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিলেট জেলায় প্রথমবারের মত ক্যাডাস্টাল
জরিপের মাধ্যমে রেকর্ড তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৫৬ সালের ২৮ মে মার্চ তারিখে আর, এস, ৪৫১১ নং বিজ্ঞপ্তি
জারি করে এই জরিপ কার্যক্রমকে ১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে
এস, এ, জরিপ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা
হয়। ফলে
সিলেট জেলায় এস, এ, জরিপটি
ছিল একটি নিয়মিত ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ।
৬. জোনাল জরিপ। প্রত্যেক
বহত্তর জেলায় একটি স্থায়ী জরিপ কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব প্রশাসনিক পুনর্গঠন সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন
কমিটির (নিকার) অনুমোদন লাভের প্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপন মলে জোনাল জরিপ স্কীম প্রবর্তন করা হয়। জোনাল
জরিপ কোন নতুন ধরণের জরিপ নয়। ইহা একটি সংশোধনী জরিপ কার্যক্রম মাত্র । এই স্ক্রীমের আওতায়
১৯৮৫-৮৬ হতে ১৯৮৫-৯০ সালের মধ্যে প্রতি। বৎসর ৪/৫টি বৃহত্তর জেলাকে জরিপ কাজের অন্তর্ভূক্ত করে সমগ্র বাংলাদেশে
জোনাল জরিপ কর্মসচি সম্প্রসারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি
বৃহত্তর জেলাকে একটি জোন নাম দেওয়া হয় এবং জোনের দায়িত্বে একজন জোনাল সেটেলমেন্ট
অফিসারকে নিয়োগ করা হয়। বৃহত্তর জেলা সদরে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের কার্যালয় করা হয়। মোট
২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে এটি পরিচালিত
হচ্ছে। এই জোনের অধীনে প্রতিটি উপজেলাকে এক একটি জরিপ ইউনিট বলে গণ্য
করা হয়েছে এবং উপজেলা পর্যায়ে সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি জরিপ অবকাঠামো প্রবর্তন করা
হয়েছে। বর্তমানে
১০টি বৃহত্তর জেলার ২০১টি উপজেলায় জোনাল জরিপ স্কীমের আওতায় সংশোধনী জরিপের (আর,এস) কাজ চলছে।
৭. দিয়ারা জরিপ। বাংলাদেশে প্রতি বছরই নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় বিপুল
পরিমাণে ভূমি নদীগর্ভে বিলীন (সিকস্তি) হয়, আবার প্রচুর পরিমাণে
নতুন চরও জেগে (পয়স্তি) ওঠে। এ চরে
পূর্বের সিকস্তি জমি পুনরায় জেগে উঠতে পারে আবার নতুন ভূ-খন্ডও হতে পারে।
দরিয়া’ শব্দ হতে ‘দিয়ারা’
শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। দিয়ারা বলতে সমুদ্র বা বড় নদীতে জেগে ওঠা চর
বা জমিকে বুঝানো হয়। দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে
চরের জমির নকশা ও খতিয়ান প্রস্তুত করাকে বুঝায়। ১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব
আইন মোতাবেক নদী পয়স্তি জমি সরকারের খাসজমির
পরিমাণ বৃদ্ধির একটি উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বিশেষ প্রকারের জমির রেকর্ড করা
হয় এই দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে। সারা দেশে দিয়ারা জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। ঢাকায় দিয়ারা জরিপের
অফিস অবস্থিত। তবে চরাঞ্চলের জমি জরিপের জন্য এর অধীনে আঞ্চলিক জেলাসমূহে (চট্টগ্রাম, নোয়াখালী,
রাজশাহী,
নরসিংদী ও বরিশাল) দিয়ারা জরিপের অফিস রয়েছে। নতুন চর জেগে উঠলে
তা জরিপ করে নকশা ও খতিয়ান প্রণয়নের জন্য জেলা প্রশাসক বা জেলা কালেক্টরের অফিস ভূমি
জরিপ অধিদপ্তরের নিকট চাহিদা পত্র প্রেরণ করে। এ চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে দিয়ারা সেটেলমেন্ট
অফিস দিয়ারা জরিপ কার্যক্রম গ্রহণ করে। মূলত ১৮৬২ সনে বর্তমান সুন্দরবন এলাকার জরিপ কাজ
পরিচালনার জন্য বা নকশা প্রস্তুত করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ‘দিয়ারা জরিপ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে দেশের
যে সকল এলাকায় নিয়মিত নদী ভাঙ্গনের কারণে ভৌগলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে শুধুমাত্র
সেইসব এলাকায় নশা ও রেকর্ড প্রস্তুতের কাজে দিয়ারা জরিপকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
৮. পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সমূহে জরিপ। আদেশের
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা হিসাবে স্বীকৃত।
এই তিনটি জেলা ১৯০০। নব হিল ট্র্যাক্ট রেগুলেশন ও ম্যানুয়াল মোতাবেক পরিচালিত হয়। ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন।
এই এলাকায় প্রযোজ্য ছিল না । তাই পার্বত্য
জেলা সমূহে কখনো ক্যাডাস্টাল জরিপ হয়নি। এখনো
এই। করলে কোন মৌজা ম্যাপ বা খতিয়ান প্রণীত
হয়নি। ১৯৮৪ সালে একটি অধ্যাদেশ জারী করে কিস্তোয়ার। জরিপের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়
কিন্তু এ কার্যক্রমের প্রতি ভুল ধারণা, বিরোধিতা ও উপজাতীয় অসন্তোষের। কারণে সরকার এই জরিপ কার্যক্রম স্থগিত করেন।
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content