সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবালের প্রাপ্যতা, চাষ ব্যবহার

সামুদ্রিক শৈবাল বা সী-উইড সাগরের এক প্রকার তলদেশীয় জলজ উদ্ভিদ (মেরিণ ম্যাক্রোঅ্যালজি)। সী-উইড বিশ্বব্যাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদিক সম্পদ, পুষ্টিগুণের বিচারে যা বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । প্রাচ্যে বিশেষত জাপান, চীন ও কোরিয়ায় সনাতনভাবেই দৈনন্দিন খাদ্যে সী-উইড ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে এবং দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপে এর ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মূলত ৩ ধরণের সী-উইডের ভেতর বাদামী অ্যালজি (৬৬%), লাল অ্যালজি (৩৩%) ও সবুজ অ্যালজি (১%) খাদ্য। হিসেবে সমাদৃত । মানব খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ডেইরী, ঔষধ, টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে সী-উইড আগার কিংবা জেল জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে কাচামাল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয় ।




তাছাড়া, জমিতে সার, প্রাণি খাদ্য ও লবণ উৎপাদনেও সীউইড ব্যবহার করা হয় । সী-উইডে প্রচুর পরিমাণে খনিজ দ্রব্য বিদ্যমান থাকায় খাদ্যে অণপুষ্টি হিসেবে এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ২৬ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক শৈবাল চাষ বা আহরিত হয়ে থাকে যার মধ্যে এশিয়ায় চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, কোরিয়া ও জাপান ৮০% এর বেশি সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন করে থাকে। বিশ্বে প্রতি বছর সামুদ্রিক শৈবালের উৎপাদন প্রায় ২০-২৮ মিলিয়ন টন যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের উপকূলীয় ৫০ মিটার গভীরতায় মহীসোপান অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৩৭,০০০ বর্গকিলোমিটার।  এ বিশাল সমুদ্র জলসীমা অত্যন্ত উর্বর এবং এখানে রয়েছে মৎস্যসম্পদসহ প্রচুর সামুদ্রিক সম্পদ। এসব সামুদ্রিক সম্পদ নবায়নযোগ্য হওয়ায়  টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় অনন্তকাল পর্যন্ত ব্যবহার। করা সম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের উপকূলে সী-উইডের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বাংলাদেশ উপকূলে সী-উইড । সামুদ্রিক শৈবাল সামুদ্রিক পরিবেশে খাদ্য উৎপাদক । বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কক্সবাজার জেলার টেকনাফসহ সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও বাঁকখালী মোহনার আশপাশের পাথুরে ও প্যারাবন এলাকায় জোয়ার-ভাটার অন্তবর্তী স্থানেই অধিকাংশ সী-উইড দেখতে পাওয়া যায় । সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ১৪০ ধরনের ও বাকখালী-মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় ৫ প্রজাতি এবং প্যারাবন  এলাকাতে  ১০ প্রকারের সী-উইড। পাওয়া যাওয়ার কথা শোনা যায় । সী-উইড জন্মানোর জন্য কিছু ভিত্তির  প্রয়োজন পড়ে ।  সাধারণত: বড় পাথর, প্রবাল, শামুক-ঝিনুক-পলিকিটের খসে , প্যারাবনের গাছ-শিকড়, শক্ত মাটি কিংবা অন্য যেকোন শক্ত বস্তুর উপর সী-উইড জন্মে । কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলের রাখাইন ও অন্যান্য উপজাতীয় জনগোঁষ্ঠী  সালাদ ও চাটনী হিসেবে সী-উইড আহার করে থাকে । স্থানীয় ভাষায় সী-উইড ‘হেজালা' নামে পরিচিত। এদেশে বাণিজ্যিকভাবে সী-উইড উৎপাদনের তথ্য পাওয়া না গেলেও বহুপূর্ব হতে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাপ্য সী-উইড পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হওয়ার কথা শোনা যায় । কক্সবাজার উপকূলে সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহ করে রৌদ্রে শুকিয়ে  প্রতি মন ৩,৫০০-৬,০০০ টাকায় স্থানীয় বাজার ও মিয়ানমারে বিক্রি করছে । বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২০১৩ সাল হতে সী-উইড নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ইনস্টিটিউট থেকে কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদী-মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় নুনিয়ারছড়া  থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত সৈকত সংলগ্ন জোয়ারভাটা এলাকা ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন সীউইডের প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষেত্র সনাক্ত করা হয়েছে। ইনস্টিটিউটের শৈবাল গবেষক দল সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ইনানী, বাঁকখালী মােহনা ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, শাপলাপুর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯১টি সী-উইডের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করেছে। এসব সী-উইডের মধ্যে প্রায় ১০টি প্রজাতি বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন ।

Caulerpa racemosa  Enteromorpha intestinalis, Padina tetrastromatica বাদামি

Sargassum oligocystum বাদামি; Hypnea musciformis লাল; Hypnea sp., Jania rubens

অণুপুষ্টি গুণ : নির্বাচিত সী-উইডের প্রত্যেকটিই প্রচুর পরিমাণে অণুপুষ্টি সমৃদ্ধ যেখানে ক্যালসিয়াম ও সোডিয়াম Jania  rubens এ সবোচ্চ ২,২৮৮,৯৯ + ০.৬ (গ্রাম/১০০গ্রাম) ও ১৬১.০°০,৪ (গ্রাম/১০০গ্রাম), Hypnea sp, এ পটাসিয়াম সর্বোচ্চ ৯৮.০+ ০.৮ (গ্রাম/১০০গ্রাম), লৌহ সর্বোচ্চ Padina tetrastromatica এ  ২৮.৭° ০.২ (গ্রাম/১০০গ্রাম), জিঙ্ক সর্বোচ্চ Cau/erba racemosa এ ০.৮ + ০,২ (গ্রাম/১০০গ্রাম) পাওয়া গেছে । যা আমাদের উপকূলীয় দরিদ্র জনগোঁষ্ঠীর। পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে পারে ।  

সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার। সামুদ্রিক শৈবাল সমুদ্র থেকে সরাসরি খনিজ পদার্থ আত্তীকরণ করে থাকে । ফলে এটি আমাদের খাদ্য তালিকার এককভাবে সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার যা অধিক পরিমাণে ভিটামিন ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। অনেক সামুদ্রিক শৈবালই মাছ/মাংসের থেকে বেশি আমিষ ও দুধের থেকে বেশি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ । আশার কথা হল, সামুদ্রিক শৈবালের এত প্রজাতির মাঝে বিষাক্ত প্রজাতির সংখ্যা খুবই সামান্য । চীন, জাপান, কোরিয়াতে সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় । কিছু সামুদ্রিক শৈবাল প্রজাতি ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান হিসেবে কাজ করে । তাছাড়া সামুদ্রিক শৈবাল প্রদাহবিরোধী ও জীবাণুবিরোধী উপাদানেও সমৃদ্ধ যা রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে । বাংলাদেশের উপকূলীয় জনসংখ্যার বিরাট অংশ সাগরে মাছ আহরণ, চিংড়ি/কাকড়া। চাষ ও লবণ চাষে জড়িত । মাছ ধরা বন্ধকালীন সময়ে উপকূলে বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ । স্বল্প পূজিতে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ একদিকে যেমন আয়ের উৎস হবে তেমনি খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনে উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন সামুদ্রিক শৈবাল উপকূলীয় জনগোঁষ্ঠীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারে । সামুদ্রিক শৈবালের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার । বাদামী ও লোহিত শৈবালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব। সবচেয়ে বেশি। খাদ্য হিসেবে সাধারণত মেয়োনিজ, জেলি, ক্রিম, পুডিং, সস তৈরিতে এদের ব্যবহার রয়েছে । সামুদ্রিক শৈবাল উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, স্ট্রোক কমায়, ডায়রিয়া, বাত রোগ নিরাময়েও সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করা হয় । অধিকাংশ সামুদ্রিক শৈবালে সামুদ্রিক লবণের চেয়ে অধিক পরিমাণে আয়োডিন রয়েছে। ফলে সামুদ্রিক শৈবাল থাইরয়েড (গলগন্ড) রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ও কাজ করে।          

বাংলাদেশে প্রাপ্ত সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে নিম্নোক্ত ১০টি শৈবাল প্রজাতি প্রাপ্যতা, চাষ, পুষ্টিমান এবং খাদ্য উপাদানের  ব্যবহারের ভিত্তিতে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ  ১. সবুজ শৈবাল (Chlorophyta) এর অন্তর্গত (Caulerpa racemosa, Enteromorpha intestinalis) ২. বাদামি শৈবাল (Phaeophyta) এর অন্তর্গত (Colpomenia sinuosa, Dictyota dichotoma, Hydroclathrus clathratus, Padina tetrastromatica, Sargassum oligocystum, Sargassum ilicifolium) ৩, লোহিত শৈবাল (Rhodophyta) এর অন্তর্গত (Asparagopsis taxifornis, Hypnea musciformis)

বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটারব্যাপি সমুদ্র সৈকত এবং ২৫ হাজার। বর্গকিলোমিটারব্যাপী উপকূলীয় অঞ্চলে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সামুদ্রিক মাছ/চিংড়ি ও কাঁকড়ার পাশাপাশি এ সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও রপ্তানি বাংলাদেশের নীল-অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য ভান্ডারে ঘাটতি দেখা দিলে সামুদ্রিক শৈবাল আগামীদিনের খাদ্য ও পুষ্টির বিকল্প ভান্ডার হতে পারে ।  সেন্টমার্টিনে ৯০ দিনে চাষকৃত Hypnea musciformis এর মোট উৎপাদন ৩০.৬১+০.২৩ কেজি (সিক্ত ওজন/মি.২) পাওয়া গেছে । বাংলাদেশ উপকূলে প্রাপ্য সী-উইডের পুষ্টিমান । সাধারণ পুষ্টিমান : নির্বাচিত সী-উইডের আদ্রতা (৮.৫৮- ২৪.৬%) যার মধ্যে Enteromorpha intestinalis সর্বোচ্চ, খনিজ দ্রব্য (৩,৯৬-২৭.৯৫%) যার মধ্যে Padina tetrastromatica সর্বোচ্চ, আমিষ (৫.৭-২২.৩১%) যার মধ্যে Hypnea sp. সর্বোচ্চ, তৈল (০.৩-২.৬৫%) যার মধ্যে Caulerpa racemosa সর্বোচ্চ, আঁশ (৪.১-৬.৮%) যার মধ্যে Padina tetrastromatica সর্বোচ্চ এবং শর্করা (৩৫.৫-৬৩.১৪%) যার মধ্যে Jania rubens সর্বোচ্চ পাওয়া গেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পানির তলদেশ বালুকাময়, পাথুরে ও প্রবাল দ্বারা আবৃত, বাকখালীর পানির তলদেশ কাদা ও বালিযুক্ত এবং ইনানীর পানির তলদেশ বালুকাময়, শিলা পাথর, খোলস চূর্ণ ও নুড়ি পাথরযুক্ত। চাষ পদ্ধতি : চাষের জন্য নারিকেলের ছোবড়ার তৈরি রশি দ্বারা ৪মি. X৪মি. জাল (২০ সেমি, ফাসযুক্ত)  আনুভুমিকভাবে স্থাপন করা হয়। নতুন জন্ম নেয়া অল্প বয়স্ক বাড়ন্ত সী-উইড প্রজাতির EnterOmorpha intestinalis, Hypnea muSciformis ও Cau/erpa racemosa গড়ে ৫ সেমি, দৈর্ঘ্যের ৪ +০.০৫ কেজি বীজ (প্রতি বর্গমিটারে ১+০.০১ কেজি) চাষের জন্য তৈরিকৃত জালের রশির গিটের ফাকে আটকিয়ে দেয়া হয় । জালটির চারপাশ বাঁশের সাথে ঢিলে করে বেধে দেয়া হয় এবং ১০টি প্লাস্টিকের বয়া বা প্লাস্টিক ফ্লোটস এমনভাবে আটকিয়ে দেয়া হয় যাতে জালটি সবসময় ০.৫ মি.- ০১ মি. পানির গভীরতায় থাকে। প্রায় ১৫ দিন পরে সী-উইড যখন ৩০+৫ সেমিদৈর্ঘ্য প্রাপ্ত হয় তখন সেগুলোর গোঁড়া বাদ দিয়ে আহরণ করা হয় । এভাবে প্রতি ১৫ দিন পরপর আংশিক আহরণ ও দৈনিক বৃদ্ধির হার নির্ণয় করা হয়।

সেন্টমার্টিন, বাঁকখালী ও ইনানীতে সী-উইডের চাষ। সাম্প্রতিক সময়ে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ এই তিন মাসের EnterOmOrpha intestinalis এর পরীক্ষামূলক চাষে সেন্টমার্টিন, ইনানী ও বাঁকখালীতে ১৫ দিন অন্তর ৯০ দিনে মোট ১৮ বার আংশিক আহরণ করা হয় । সেন্টমার্টিনে ৬০তম দিনে সর্বোচ্চ ২৫.১০ + ০.৩৬ কেজি (সিক্ত ওজন) এবং ১৫তম দিনে সর্বনিম্ন ১১.৫৪ +০.২৮ কেজি (সিক্ত ওজন) আংশিক আহরণ করা হয় । বাঁকখালীতে ৬০তম দিনে সর্বোচ্চ ২১.৭৩ +০.৪০ কেজি এবং ১৫তম দিনে। সর্বনিম ১০.১০+০.৪০ কেজি আংশিক আহরণ করা হয় । ইনানীতে ৪৫তম দিনে  সর্বোচ্চ ১২.৭৭+ ০.২৫ কেজি এবং ৯০তম দিনে সর্বনিম্ন ৭.২১+ ০.১০ কেজি  আংশিক আহরণ করা হয় ।

********************************************************************************




Post a Comment

Please do not link comment any spam or drive spams content

Previous Post Next Post