বাংলাদেশে রাজ কাকড়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাবনা
রাজ কাকড়া (Horseshoe crab) প্রকৃতপক্ষে কাকড়া নয় তবে কাকড়ার সাথে। সাদৃশ্যযুক্ত সামুদ্রিক অ্যারাকনিড (Arachnids)। এরা Xiphosura (গ্রীক XiphoS, তলোয়ার ও uroS, লেজ) বর্গের অন্তর্ভূক্ত। পৃথিবীব্যাপি রাজ কাকড়ার ৪টি প্রজাতি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গালফ উপকূল ও আটলান্টিক মহাসাগরে বসবাসরত Limulus polyhemus; জাপান, চনি এবং দক্ষিণ সাবাহ (মালয়েশিয়া) অঞ্চলের Tachypleus tridentatus এবং বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার Tachypleus gigas ও Carcinoscorpius rotundicauda প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণিকে জীবন্ত জীবাশ’ (Living fossil) নামে অভিহিত করা ।
হয় যা প্রায় ৫৫ কোটি বছর পূর্বে ট্রাইলোবাইট (Trilobite) থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই উন্নত হওয়ায় অঙ্গসংস্থানিক পরিবর্তন ছাড়াই পৃথিবীতে এখনও টিকে আছে। প্রায় ৪০ কোটি বছরেরও পুরানো রাজ কাঁকড়ার জীবাশ্ম যেমন Mesolimulus walchii (জার্মানীতে প্রাপ্ত) ও Austrolimus (অস্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্ত) বর্তমানকালের জীবিত প্রজাতিগুলোর প্রায় অনুরূপ বর্শায় ন্যায় লেজযুক্ত এই চেলিসেরেটদের (Chelicerates) অশ্বখুরাকৃতির কাঁকড়া বলা হয় কারণ এদের পৃষ্ঠীয় প্লেট (Carapace) দেখতে অশ্ব খুরের মতো । পুরুষ রাজ কাকড়া আকারে ছোট হওয়ায় সহজেই স্ত্রী কাকড়া ।
থেকে এদের পৃথক করা যায় এবং এদের নখরযুক্ত পায়ের (clawed walking legs) স্ফীত প্রোপোডাস (Propodus) সঙ্গমের সময় ক্লাসপার (claspers) হিসেবে কাজ করে ।
বাংলাদেশের রাজ কাঁকড়া
বাংলাদেশে C. rotundicauda মোহনা ও মহীসোপান অঞ্চলে দেখা যায় এবং প্রায়শই মাছ ধরার জালে ধরা পড়ে। কক্সবাজার উপকূল, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, মহেশখালি এবং সুন্দরবনের নদী ও চরে সচরাচর এটিকে দেখা যায় । T. gigas কক্সবাজারস্থ টেকনাফের জোয়ার-ভাটা অঞ্চল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে পাওয়া যায় তবে সাধারণত সুন্দরবনে দেখা যায় না। রাজ কাকড়া সাগরের উষ্ণ, অগভীর উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীমুখের ৩০ মিটার গভীরতায় বসবাস করে। যখন প্রজননের জন্য এরা। অগভীর পানিতে যায় এবং কাদাময়/বালুময় সৈকতে ডিম ছাড়ে তখন খুব সহজেই। দৃষ্টিগোচর হয়।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অংশে প্রাপ্ত রাজ কাঁকড়া C. rotundicauda বাদামী রঙের হয় যা এদের আবাসস্থলের ওপর নির্ভরশীল । সুন্দরবনে প্রাপ্ত রাজ কাকড়া গাঢ় সবুজ অথবা সবুজাভ কালো রঙের হয় । তবে T. gigas প্রজাতির দেহ সমভাবে বিস্তৃত ধূসর রঙের পৃষ্ঠীয় অংশ এবং ফ্যাকাসে ধূসর অঙ্কিয় অংশ বালুময় আবাসস্থলের সাথে সহজেই মিশে যায় ।
C. rotundicauda অশ্বখুরাকৃতি কাকড়ার মধ্যে সবচেয়ে
ছোট । দেহের মোট দৈর্ঘ্য। (পুচ্ছ কাটা ব্যাতীত) ১১.৭-১৫.১ সেমি., পুচ্ছ
কাঁটা/টেলসনের দৈর্ঘ্য ১৩.২১৭.৪ সেমি.। T.
gigas এর দেহের মোট দৈর্ঘ্য ৩৫ সেমি. (সর্বোচ্চ ৫০ সেমি.) ও দেহের ব্যাস ২৫ সেমি.
।
জীবনচক্র :
রাজ কাকড়া ৯-১২ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। পর্ণ জোয়ারে এরা প্রজনন করে এবং তখন এরা কক্সবাজার, সোনাদিয়া, মহেশখালি এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিকটে খাড়ি বা জলাভূমির বালুময় সৈকতে ফিরে আসে। সুন্দরবনের চর এলাকা হচ্ছে C. rotundicauda এর প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র তবে অন্যান্য সকল উপকূলীয় এলাকায় ২ প্রজাতির রাজ কাকড়াই প্রজনন করে থাকে।
C. rotundicauda বসন্তের শুরুতে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) কর্দমাক্ত সৈকতে এবং T. gigas গ্রীষ্মের শুরুতে (এপ্রিল-জুন) বালুময় সমুদ্র সৈকতে প্রজনন করে । প্রজনন কালে একটি স্ত্রী ২,০০০ থেকে ৩০,০০০ ডিম ছাড়ে; পুরুষ রাজ কাকড়া। ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে বালুর মধ্যে লুকিয়ে রাখে ।
C. rotundicauda এর। ডিমের ব্যাস ২.২৬-২.৪৮ মিমি. এবং T. gigas এর ডিমের ব্যাস প্রায় ৩.৫ মিমি.। বড় ডিমের মধ্যে এদের লার্ভাগুলো ছোট লালচে গোলকের মতো দেখায় এবং বাচ্চা। ফুটতে ৬ সপ্তাহ সময় লাগে । অতঃপর প্রায় ১৬ বার খোলস পরিবর্তনের মাধ্যমে। এরা প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। প্রাথমিক অবস্থায় লার্ভাগুলোকে ট্রাইলোবাইটদের মতো দেখায় এবং তাই এদেরকে ট্রাইলোবাইট। লার্ভা (Trilobite larvae) বলা হয় ।
এরা ১২-১৯ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। খাদ্যাভাস : রাজ কাঁকড়া মূলত জৈব
আবর্জনাভূক (Scavenger) প্রাণি। এদের অধিকাংশই সমুদ্রের তলদেশের কাদার মধ্যে বসবাস
করে এবং সেখানে এরা ছোট প্রাণি, পোকা-মাকড়, ক্রাস্টাশিয়ান, মোলাস্ক এবং এমনকি ছোট
মাছ শিকার করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
এরা প্রধানত নিশাচর। এই নিশ্চল প্রাণিরা খাদ্য
সংগ্রহের জন্য কাদা ও বালুর মধ্যে গর্ত করে সময় কাটায় । এরা
অত্যন্ত পরিবেশ সহিষ্ণু ও সপ্তাহকালব্যাপি পানি এমনকি খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে রাজ কাকড়ার ফুলকা অবশ্যই ভিজা থাকতে হবে ।
রাজ কাকড়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বিংশ শতাব্দির প্রথম অংশে আমেরিকায় রাজ কাঁকড়া সার ও পশু খাদ্য তৈরিতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হতো । দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেমন : থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও চীনে রাজ কাঁকড়ার ডিম সুস্বাদু খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয় । থাইল্যান্ডে রাজ কাঁকড়ার ডিম সমৃদ্ধ খাবার ‘Thai cuisine' এবং 'Yum Khai Mengda Talay' নামে পরিচিত যদিও অনেক সময় এই ডিমে Tetrodotoxin নামক এক ধরণের টক্সিন পাওয়া যায় যা অধিকাংশ সময়ই মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাড়ায়। আবার এই Tetrodotoxin কিছু কিছু রোগ যেমন তীব্র ব্যথা, ক্যান্সার, মাইগ্রেইনসহ Cardiac arrhythmias এর মতো দূরারোগ্য রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধ হিসেবে কাজ করে ।
পশ্চিমা বিশ্বে এদেরকে নীল রক্তের জন্য সংগ্রহ করা হয়। এদের রক্তে Limulus amoeboCyte lysate (LAL) নামক এক ধরণের কেমিক্যাল থাকে যা। pathogens এবং তাদের endotoxins চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়। এই নীল রক্ত মানুষের মানসিক অবসাদ ও আন্ত্রিক পীড়াজনিত রোগ নিরাময়ের ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও উন্নত বিশ্বে এই নীল রক্ত দাঁতের পাল্প তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয় ।
এদের রক্তের এনজাইম ঔষধ এবং
জৈব চিকিৎসা শিল্পে মানুষের জীবন রক্ষার্থে ইন্ট্রাভেনাস ড্রাগ এবং ব্যাকটেরিয়ার
প্রোসথেটিক গ্রুপের বিশুদ্ধতা পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে চিকিৎসা
যন্ত্রপাতির এন্ডোটক্সিন দূষণের পরীক্ষায়ও রাজ কাকড়া ব্যবহৃত হয় ।
সুন্দরবন এলাকার জেলেরা এর লেজের ফাঁপা টুকরা সুতার সাহায্যে মালা বানিয়ে। ব্যাথানাশক (যেমন বাত জ্বরের ব্যথা) হিসেবে গলায় ব্যবহার করে । মহেশখালি ও সােনাদিয়া দ্বীপের উপজাতীয় মগরা রাজ কাকড়ার ডিম তেলে ভেজে খায় ।
রাজ কাঁকড়া উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় জৈব-আবর্জনাভােজী বা সর্বভূক
খাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজ কাঁকড়া মানুষ এবং পরিবেশের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক।
রাজ কাঁকড়ার কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা
রাজ কাকড়ার কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তেমন কোন বিস্তারিত তথ্য থাকলেও এটা জানা যায় যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড, হংকং, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে বিরল এই সামুদ্রিক প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রাজ কাকড়ার চাষ ইনডোর বা আউডোর দুই পদ্ধতিতেই হতে পারে। শীতকালে যখন সমুদ্রের ।
পানির তাপমাত্রা ১০° সেন্টিগ্রেডের নিচে নেমে যায় তখন এরা বালির নিচে গর্ত করে লুকিয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, চাষে রাজ কাকড়ার খাদ্য গ্রহণের । হার পানির তাপমাত্রার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত । ২০-২৮° সেন্টিগ্রেড। তাপমাত্রায় এরা সর্বোচ্চ হারে খাবার গ্রহণ করে।
৩০° সেন্টিগ্রেড এর বেশি । তাপমাত্রায় এবং ১৬° সেন্টিগ্রেড এর কম
তাপমাত্রায় এরা আকস্মিকভাবে খাওয়া। কমিয়ে দেয় । বাংলাদেশে রাজ কাঁকড়া একটি
বিপন্ন প্রজাতি এবং বিশ্বব্যাপি অতি আহরণ ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে আবাসস্থল
ধ্বংসের ফলে এদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় এদেরকে বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভূক্ত করা
হয়েছে। রাজ কাকড়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব মাথায় রেখে আমাদের দেশে এই সামুদ্রিক
প্রাণির প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে ।
Source: Bangladesh Fisheries Research Institute
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content