উপকূলে সবুজ ঝিনুক (Green Mussel) চাষের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল সমুদ্রসীমা ও ৩.২২ মিলিয়ন হেক্টর উপকূলীয় জলজ এলাকা যা মাৎস্যসম্পদের উৎপাদন আরো বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। উপকূলীয় এলাকা বাংলাদেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ দখল করা সত্ত্বেও প্রতিকূল পরিবেশ ও সদা পরিবর্তনশীল লবণাক্ততার কারণে চিংড়ি চাষ ব্যতীত অন্য কোন ফসল চাষ দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। উপকূলীয় এলাকায় বাগদা চিংড়ির চাষ যেমন বাংলাদেশের জন্য বয়ে। এনেছে সাফল্য তেমনি অদূর ভবিষ্যতে যুগোপযোগী সাফল্য বয়ে আনবে সবুজ ঝিনুক (Green mussel) এর চাষ । সবুজ ঝিনুক Mollusca পর্বের Mytilidae গোত্রের ও Perna গণের এক প্রকারের ঝিনুক যার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Perna viridis। এদেরকে প্রধানত ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রান্তীয় ও উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া যায়। সবুজ ঝিনুকের পরস্পরযুক্ত দুটি ডিম্বাকৃতির খোলস থাকে
এরা দৈর্ঘ্যে
সাধারণত ১০০ থেকে ১৫০ মিমি. হয়ে থাকে। সবুজ ঝিনুক প্রধানত ছাঁকন পদ্ধতিতে
প্রাকৃতিক খাবার যেমন ফাইটোপ্ল্যাংকন বা জুয়োপ্ল্যাংকন এবং অন্যান্য জৈবকণা খেয়ে
জীবন ধারণ করে। এরা বাইসাস থ্রেড (BySSus thread) এর মাধ্যমে কোন অবলম্বনের সাথে
সংযুক্ত হয়ে জীবণধারণ করে থাকে। পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবক যেমন তাপমাত্রা,
লবণাক্ততা, প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুর্যতা ইত্যাদির প্রভাবে বছরের বিভিন্ন সময়
যেমন বসন্তের শুরুর দিকে এবং শরতের শেষের দিকে এরা ডিম দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে যদিও সবজ ঝিনুকের চাষ এখনে প্রচলিত হয়ে ওঠেনি কিন্তু এদের। মাংস ও খোলসের বিশ্বব্যাপি চাহিদার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদের চাষ খুব জনপ্রিয় । চীন, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভারত এ সুলভ প্রোটিনের উৎস। হিসেবে সবুজ ঝিনুক এর চাষ খুবই প্রচলিত । এমনকি সিঙ্গাপুর এর মতো একটি উন্নত দেশের মাৎস্যসম্পদ উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়েই রয়েছে সবুজ ঝিনুক । থাইল্যান্ড হলো বিশ্বে সবুজ ঝিনুক এর দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক । মালয়েশিয়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সবুজ ঝিনুক চাষ করে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সবুজ ঝিনুকের চাষ উপজাতি জনগোষ্ঠীর প্রোটিনের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে ।
সবুজ ঝিনুক চাষের সুবিধাসমূহ
• এদের বৃদ্ধি খুব দ্রুত
হয় এবং অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় । প্রাকৃতিক উৎস হতেই স্প্যাট (Spat) বা বীজ
পাওয়া যায় ।
সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক
খাবারের ওপর নির্ভরশীল তাই এদের চাষ করতে কোন প্রকার বাহ্যিক খাদ্য খরচের প্রয়োজন
পড়ে না ।।
এদের মাংস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপাদেয় খাদ্য তাই রপ্তানি চাহিদাও
প্রচুর। এদের খোলস চুন উৎপাদন, মাছ ও পোলট্রি খাবারে ক্যালসিয়াম এর উৎস। হিসেবে
ব্যবহৃত হয় । ও সবুজ ঝিনুক খুব অল্প সময়েই বাজারজাত করা যায় ।
চাষ ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও প্রযুক্তিগত খরচ অন্যান্য জলজ প্রাণির
চাষের তুলনায়।
তুলনামূলক কম হওয়াতে এদের চাষ জনপ্রিয়।
বাংলাদেশে সবুজ ঝিনুক
চাষের সম্ভাবনা
• উপকূলীয় যেসব উন্মুক্ত লবণাক্ত জলাশয় এখন পর্যন্ত কোন প্রকার
চাষের
আওতায় আসেনি, সবুজ ঝিনুক চাষের মাধ্যমে সেসব এলাকার সঠিক ও লাভজনক
ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। • উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। •
প্রায় ২০ লক্ষ উপজাতি জনগোষ্ঠীর নিয়মিত খাবার হিসেবে আমিষের চাহিদা।
পূরণে ভূমিকা রাখবে ।
ইউরোপীয় দেশসমূহে রপ্তানি চাহিদা অনেক বেশি হওয়ায় দেশের চাহিদা।
মেটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে
ভূমিকা রাখবে এবং নতুন একটি রপ্তানি বাজার
তৈরি হবে ।
১ এদের খোলস মাছ ও পোল্টি খাদ্যে ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে এবং
চুন।
তৈরির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
উপকূলীয় এলাকাসমূহে সবুজ ঝিনুক প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য নতুন
শিল্প ও সবুজ ঝিনুকের দেশীয় বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে ।
• বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা ও উপকূলীয় এলাকার নতুন একটি
অর্থনৈতিক ।
সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে অবদান রাখবে। দেশের সামগ্রিক
মাৎস্যসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশে সবুজ ঝিনুক
নিয়ে গবেষণা
বাংলাদেশে সবুজ ঝিনুকের চাষ পদ্ধতির উন্নয়ন ও বিস্তারের লক্ষ্যে
চট্টগ্রাম। ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় এর মাৎস্যবিজ্ঞান
অনুষদ।
‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’ এর NATP-2 প্রকল্পের অর্থায়নে
গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে । এই প্রকল্পে চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার রেজুখাল,
মহেশখালী, কুতুবদিয়া চ্যানেলের প্রতিটিতে ৫টি গবেষণা স্থান ও টেকনাফ উপজেলার নাফ
নদীতে সবুজ ঝিনুক চাষের সম্ভাব্যতা ও চাষ পদ্ধতি উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা
কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গবেষণা কাজের শুরুতে উল্লেখিত এলাকাসমূহে চাষের
উপযুক্ততা যেমন : গভীরতা, স্রোত, তাপমাত্রা, প্রাকৃতিক খাদ্য ও উক্ত প্রজাতির
প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতা, লবণাক্ততা, অম্লত্ব, ক্ষারকত্ব, দ্রবীভুত অক্সিজেন
উপস্থিতিসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে গবেষণা স্থানসমূহ নির্বাচন করা। হয়। অতঃপর
প্রাকৃতিক উৎস হতে স্প্যাট বা বীজ সংযুক্ত হওয়ার জন্য চার । প্রকারের অবলম্বন
যথাক্রমে দড়ি, ফাঁসযুক্ত মোটা দড়ির জাল, বাঁশ, বাঁশ ও জালের। তৈরি খাঁচা ইত্যাদি
অবলম্বন হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপন করা হয়। নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে ব্যবহৃত বিভিন্ন অবলম্বনে তুলনামূলকভাবে সবুজ ঝিনুকের স্প্যাট
সংযুক্ত হওয়ার হার পর্যবেক্ষণ করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময় ব্যাপ্তি অনুসারে
নমুনা সংগ্রহ করে গড় বৃদ্ধি হার, মৃত্যু হার, গোনাডের পরিপক্কতা, প্রজনন
স্বাস্থ্য, প্রজনন হার ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়। পানির প্রায় ২ মিটার গভীরে
তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার ক্রমপরিবর্তন কম হওয়ার কারণে সবুজ ঝিনুকের সর্বোচ্চ
বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে।
তাছাড়া প্রাকৃতিক উৎস ও চাষকৃত উৎস থেকে সবুজ ঝিনুক এর পরিপক্ক
নমুনা। সংগ্রহ করে গবেষণাগারে এদের পুষ্টিগত উপাদানের তুলনামূলক পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পদ্ধতিতে সবুজ ঝিনুকের চাষে খুবই আশানুরূপ। ফলাফল
পাওয়া গেছে। উপকূলীয় এলাকায় সবুজ ঝিনুক চাষের বিস্তার ঘটাতে এই গবেষণা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায় ।।
সবুজ ঝিনুকের চাষ উপযোগী
স্থানের বৈশিষ্ট্য
• পানির গভীরতা সর্বনিম্ন
১ মিটার (ভাটার সময়) হতে হবে। •
তাপমাত্রা ২৫.৩০ থেকে ৩৪.৬০ সেলসিয়াস থাকতে হবে C স্রোতের গতি কম থাকা বাঞ্চনীয়।
• স্প্যাট সংযুক্ত হওয়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা বা অবলম্বন থাকা প্রয়োজন। •
প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুর্যতা থাকতে হবে ।
সবুজ ঝিনুকের চাষ পদ্ধতি
সবুজ ঝিনুক প্রধানত নিমজ্জিত বা ভাসমান ভেলায় (Raft), খাঁচায়, লং
লাইন। (Long line) বা সরাসরি তলদেশে চাষ করা যায়। তাছাড়া, বিভিন্ন রকম। অবকাঠামো
নির্মাণ করেও এদের চাষ করা যায়। তবে গবেষণালব্ধ
ফলাফলের । ভিত্তিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনাপূর্বক বিভিন্ন ধরণের ভাসমান
অবকাঠামোই চাষের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করা হয় । সবুজ ঝিনুকের প্রজনন মৌসুম হলো
জুন-জুলাই ও ডিসেম্বরজানুয়ারি । প্রজনন মৌসুমের পূর্বেই চাষের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ ও স্থাপন করা। বাঞ্ছনীয়। একটি
প্রচলিত ভাসমান পদ্ধতিতে সাধারণত
নির্বাচিত চাষ উপযোগী এলাকায় বিভিন্ন মধ্যমাকারের প্লাস্টিকের ড্রাম বা ব্যারেল নির্দিষ্ট দূরত্বে কয়েক সারি শক্ত
দড়ির সাথে বেঁধে দেয়া হয় যেগুলো সম্পূর্ণ কাঠামোকে ভাসিয়ে রাখার কাজ করে থাকে।
এরপর ড্রামসহ সম্পূর্ণ অবকাঠামোটিকে দড়ির
সাহায্যে দুইপাশ থেকে কয়েকটি খুঁটির গাঁথুনির সাথে বেঁধে দেয়া হয় যাতে
অবকাঠামােটি জোয়ার-ভাটায়। ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে এবং স্রোতে ভেসে যেতে না
পারে। নির্মিত অবকাঠামোটিতে বিভিন্ন ধরণের অবলম্বন ব্যবহার করা হয় যাতে
প্রাকৃতিকভাবে।
স্প্যাট সংযুক্ত হতে পারে। গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী
অবলম্বন হিসেবে । বিভিন্ন ধরণের দড়ির ব্যবহারে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া গেছে। দড়ির
মধ্যে মূলত | ১০ ফুট দৈঘ্যের জাহাজে ব্যবহৃত মোটা পাটের ও নাইলনের দড়ি ব্যবহার
করা। | যেতে পারে। এই দড়িগুলোকে মূল দড়িটির সাথে নির্দিষ্ট দূরত্বে এমনভাবে
সংযুক্ত | করা হয় যাতে তারা তলদেশের নুন্যতম এক ফুট উপরে থাকে। গবেষণা
ফলাফলে | দেখা গেছে যে, এই ধরণের দড়ি ব্যবহারের ফলে প্রতি ফুট দড়িতে ২৫০ থেকে ।
৩০০টি পর্যন্ত স্প্যাট সংযুক্ত হয়েছে। এভাবে সহজে এবং অল্প খরচে উপকূলীয় ।
এলাকায় সবুজ ঝিনুক চাষের অবকাঠামো নির্মাণ করা যেতে পারে ।।
প্রজনন মৌসুমের এক থেকে দুই মাস পরে প্রাকৃতিকভাবে স্প্যাটগুলো
(২-৫ সপ্তাহ বয়স, ০.২৫-০.৩ মিমি, যে
অবস্থায় বীজগুলো কোন কাঠামোতে সংযুক্ত হয়) নির্মিত অবকাঠামোতে সংযুক্ত হতে শুরু করে। নির্দিষ্ট
সময় ব্যবধানে সংযুক্ত হওয়ার হার ও বৃদ্ধি
পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রায় ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে এরা। বাজারজাতকরণের উপযোগী
(৩৫-৪০ মিমি.) হয়ে ওঠে। স্বল্প আয়তনের আমাদের এই দেশের রয়েছে বিশাল সমুদ্রসীমা
ও উৎপাদনক্ষম। উপকূলীয় এলাকা যার অধিকাংশ অংশেরই সঠিক ব্যবহার এখনে নিশ্চিত হয়নি । সবুজ ঝিনুক চাষ এমনই এক
সম্ভাবনার নাম যা আমাদের ব্লু ইকোনোমি আরো
সচল করে উপকূলীয় এলাকাসমূহকে গড়ে তুলতে পারে অর্থনীতির এক বিশাল চালিকাশক্তি
হিসেবে । অবদান রাখতে পারে আমাদের মাৎস্যসম্পদ উৎপাদন। বৃদ্ধিতে ।
সূত্র ঃ বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তর ময়নসিংহ ২২০১
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content