Global warming Biodiversity changing
বিশ্বের প্রত্যেক দেশেই বিশেষত: বাংলাদেশে স্বাভাবিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় বন্যা, টর্নেডো, ঝড়ঝঞ্ঝা ও সাইক্লোনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঘটেছে পরিবেশগত বিপর্যয়। এ বিপর্যয়ের ফলে অন্যান্য জীবের সাথে সাথে মানুষের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকতে পারবে কী না, এ বিষয়ে সর্বত্র জোর আলোচনা চলছে। অনুষ্ঠিত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর বিশ্ব সম্মেলন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশেও বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। নগরায়ন, শিল্পায়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথেচ্ছা প্রয়োগ পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। প্রকৃতিকে বশে আনতে গিয়ে মানুষ প্রকৃতির সাবলীল গতি ব্যাহত করেছে এবং করছে।পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর মানবসমাজের অত্যাচার এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রকৃতির এ বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
পরিবেশ দূষণকারী অপদ্রব্যগুলো মোটামুটি দু'ভাগে বিভক্ত। এক- প্রাকৃতিক দুই- কৃত্রিম।
প্রাকৃতিক দূষকের মধ্যে রয়েছে সীসা, পারদ, সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি।
কৃত্রিম দূষকের অন্তর্গত হলো নানা কীটনাশক, গুঁড়ো সাবান, ওষুধপত্র ও প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি প্লাস্টিকও। এসব যৌগের কয়েকটি আমাদের পরিবেশে বহুদিন ধরে টিকে থাকে। রোদ, পানি, বাতাস, জীবাণু এদের কোন ক্ষতিই করতে পারে না। এ ধরনের যৌগ নিয়েই পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তা বেশি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বৃক্ষনিধন, শিল্প-কারখানা স্থাপন, দূষণ ও নগরায়নের ফলে আবহাওয়ায় একটি দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যেহেতু পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি আঘাত করছে জনবসতির ওপর।
গত ১০০ বছরে পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, গত দশ বছরে যে সকল ঝড়, বন্যা ও দাবানল হয়েছে তা এ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ ফল। বিশ্বের উষ্ণতম বিশটি বছরের মধ্যে উনিশটি ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল-এর মধ্যে। ২০০০-২০০৯ বিশ্বের উষ্ণতম দশক হিসেবে স্বীকৃত।
একদিকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমন ক্রমাগত বাড়ছে, অন্যদিকে 'উন্নয়ন' এর নামে প্রতিনিয়ত বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে আরও বেশি পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরোকার্বনসহ আরও কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস মজুদ হয়ে গ্রিন হাউজ প্রভাব সৃষ্টি করছে।
বায়ুমণ্ডলের বাইরের দিকে যে ওজন গ্যাসের আবরণ আছে, তা ক্রমেই ক্ষয় হচ্ছে। ওজনস্তরের ক্ষয়ের ফলে আগে যেভাবে পৃথিবীতে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির আগমন বাধাগ্রস্ত হতো, এখন তার প্রবেশ সেই পরিমাণে আটকানো যাচ্ছে না।
যা হোক, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন দারুণ বিপর্যস্ত এবং এটি প্রকৃতির জন্যও ভীষণ হুমকি। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট ঝুঁকিগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে ভূমিক্ষয়, ভূমিকম্প, পানি এবং ভূমির লবণাক্ততা, দূষণ এবং আর্সেনিক দূষণ নিয়ে আসে। ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকায় ভাঙ্গন আনে এবং পাললিক ভূমির ভীষণ ক্ষতি করে।
উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভস্হ গভীর নলকূপের পানি হয়ে দাঁড়িয়েছে পানীয় জলের উত্স। কিন্তু এই পানির অতিরিক্ত উত্তোলন প্রকৃতিতে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে আসে।
জলবায়ু পরিবর্তনে গলে যাচ্ছে পর্বতশিখরের বরফ, মেরু অঞ্চলের হিমবাহ। ফলে সমুদ্রের পানির স্তর উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। একসময় সমুদ্রের লোনাপানি প্লাবিত করবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
বাংলাদেশের প্রায় ১৭% ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে বলে অনেক গবেষক আশঙ্কা করেছেন। ২০০৪ সালে 'নেচার' পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বিশ্ব তাপনের প্রভাবে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ১০ লাখ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কীভাবে এর মোকাবিলা ও প্রতিরোধ সম্ভব?
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতগুলো কর্ম পরিকল্পনা প্রস্তাব করে।
১. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখা এবং সহস্রবর্ষীয় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, যখন কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটবে।
২. জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক আঘাত নিয়ন্ত্রণ বা মোকাবিলা করা। ৩. জলবায়ুর জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উন্নয়নের জন্য একটা পদ্ধতিগত এবং কার্যকর বৃত্তি বা পেশা প্রতিষ্ঠা এবং ৪. সুনির্দিষ্ট সেক্টর চিহ্নিত করা, সেই সাথে জাতীয় এবং আঞ্চলিকভাবে যথাযথ অভিযোজন এবং প্রশমন সাড়াসমুহ।
জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়ে ১২ দিন ব্যাপী ধরিত্রী সম্মেলন। ২০০৯ সালের ৭-১৮ই ডিসেম্বর UNFCC এর ১৯২টি সদস্যদেশের অংশগ্রহণে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৫তম জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এটি কাঙ্খিত সাফল্য না আনলেও দরিদ্র দেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতা প্রদান ও ক্রমান্বয়ে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সম্মত হয় উন্নত দেশের নেতারা।
গত ১৪ মে বাংলাদেশ সেন্টার ফর এডভান্সড স্টাডিস ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশস্থ ফরাসি দূতাবাসের সহযোগিতায় রাজশাহীতে দিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
বলা যায়, জলবায়ু ইস্যুটি মানব অস্তিত্বের এক সর্বাত্মক এবং অত্যাবশ্যক বিষয়। মানুষের টিকে থাকা, জীবিকা, উন্নয়ন এবং পরিবেশের সাথে সর্বাঙ্গীন সম্পর্ক নির্ভর করে জলবায়ু পরিস্থিতির উপর।
সুতরাং ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক পারস্পরিক বোঝাপড়া, উত্কৃষ্টতর সংলাপ, উপযোগী বিনিয়োগ, পারস্পরিক ফাণ্ড এবং জাতিসমূহের মধ্যে আলোচনা লক্ষ্যে পৌঁছতে উপযোগী ও কার্যকর হবে।
Credit @মাশহুদাআখতার: প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজ, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ
Post a Comment
Please do not link comment any spam or drive spams content